Thursday, July 4, 2013

দুবাইয়ে বাংলাদেশি ট্যাক্সিচালক আব্দুল হালিম। সম্পদ নয়, মনের শান্তিটাই তাঁর কাছে বড়

  • দুবাইয়ে বাংলাদেশি ট্যাক্সিচালক আব্দুল হালিম। সম্পদ নয়, মনের শান্তিটাই তাঁর কাছে বড়
    দুবাইয়ে বাংলাদেশি ট্যাক্সিচালক আব্দুল হালিম। সম্পদ নয়, মনের শান্তিটাই তাঁর কাছে বড়
  • ‘যাঁর টাকা তাঁরে ফিরায় দিছি। এখন দেখেন, কত ভালো আছি’
    ‘যাঁর টাকা তাঁরে ফিরায় দিছি। এখন দেখেন, কত ভালো আছি’
  • দুবাই আরটিএ (রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) কর্মকর্তার হাত থেকে সততার পুরস্কার, সনদপত্র নিচ্ছ
    দুবাই আরটিএ (রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) কর্মকর্তার হাত থেকে সততার পুরস্কার, সনদপত্র নিচ্ছেন হালিম
  • নিজ বাড়ির সামনে হালিমের গর্বিত বাবা-মা—মনু মিয়া ও শ্যামলা বেগম
    নিজ বাড়ির সামনে হালিমের গর্বিত বাবা-মা—মনু মিয়া ও শ্যামলা বেগম
    ছবি: এম সাদেক

‘হ্যালো’, ফোনের ওপাশের কণ্ঠস্বরে ব্যস্ততা আর ক্লান্তির মিশেল।
‘আব্দুল হালিম বলছেন?’
বাংলায় প্রশ্ন করতেই কিছুক্ষণ নীরবতা। ওপাশের মানুষটা বোধ হয় মুঠোফোনের পর্দায় তাকিয়ে নিশ্চিত হলেন, ফোনটা বাংলাদেশ থেকেই এসেছে। ‘জি ভাই, বলেন,’ আব্দুল হালিমের গলার স্বরে এবার আন্তরিকতা। ক্লান্তি-ব্যস্ততা হাওয়া!
দুবাইয়ের ট্যাক্সিচালক তিনি। হাসি-খুশি তরুণ আর তাঁর পেছনের ঝলমলে শহরটা কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম। কথা বলতে বলতে মনে হলো কোথায় ঝলমলে শহর, কোথায় দুবাই? এ যে আমাদের কুমিল্লার কালিন্দীপাড়া গ্রামের আব্দুল হালিম, ডাকনাম শুভ! দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও আব্দুল হালিমের কণ্ঠে ‘বিদেশি বাতাস’ খুব একটা লাগেনি। মনটা এখনো এ দেশেই পড়ে আছে।
ইন্টারনেট, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বিভিন্ন সূত্র থেকে ইতিমধ্যেই অনেকের আব্দুল হালিমের গল্প শোনা হয়ে গেছে। তাঁর নিজ মুখে শুনব বলে আরও একবার জানতে চাইলাম। লম্বা একটা দম নিয়ে আব্দুল হালিম শুরু করলেন, ‘সেদিন ছিল ২৫ মে...।’

চিচিং ফাঁক
আব্দুল হালিম দুবাইয়ের রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (আরটিএ) অধীনে চাকরি করেন। সকালবেলা ট্যাক্সি নিয়ে বের হন, বিকেলে আরেকজন চালকের হাতে ট্যাক্সি বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর ছুটি। সেদিন ১১টা নাগাদ দুবাইয়ের জেএলটি এলাকার আলমাস টাওয়ারের সামনে থেকে আব্দুল হালিমের ট্যাক্সিতে উঠলেন দুজন মিসরীয় ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে থাকা বাক্সপেটরাগুলো রাখা হলো গাড়ির পেছনের ডালার ভেতরে। গন্তব্য গোল্ড সোউক। আধঘণ্টার যাত্রাপথ। সাড়ে ১১টা নাগাদ যাত্রী দুজনকে নির্ধারিত স্থানে নামিয়ে দিয়ে হালিম নিজের পথ ধরলেন। সারা দিন আরও অনেক যাত্রী হালিমের ট্যাক্সিতে উঠলেন এবং নামলেন। যথারীতি বিকেল চারটায় ডিউটি শেষ হলো। গাড়ি ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেবেন বলে শেষবারের মতো গাড়ির সবকিছু দেখে নিচ্ছিলেন হালিম। প্রতিদিনের অভ্যস্ততায় গাড়ির পেছনের ডালা খুললেন। দেখলেন, বাদামি রঙের একটি চামড়ার ব্যাগ।
অনেক যাত্রীই ভুল করে ব্যাগ ফেলে যান। এটা নতুন কিছু নয়। একবার এক পরিবার নাকি তাঁদের ছোট বাচ্চাটাকে ভুলে ট্যাক্সিতে ফেলে নেমে গিয়েছিল; এমন ঘটনাও প্রচলিত আছে এই ধনকুবেরদের শহরে। ব্যাগের মালিকের সন্ধান পেতে হলে ব্যাগটা খুলে দেখতে হবে, তা ছাড়া কৌতূহলও কিছুটা হচ্ছিল বৈকি। হালিম ব্যাগ খুললেন। এবং খুলেই তাঁর চোখ ছানাবড়া! ব্যাগভর্তি চকচকে ৫০০ দিরহামের বান্ডিল, সঙ্গে বেশ কিছু হীরার গয়না আর দামি ঘড়ি!
হালিম হতভম্ব! এমন ৫০০ দিরহামের অল্প কিছু নোট তাঁর মাসিক আয়। একসঙ্গে এতগুলো দিরহাম আগে কখনো চোখেও দেখেননি। এত দামি হীরার গয়নাও কখনো হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। গাড়ির পেছনে পাওয়া এসব ধন-সম্পদ তাঁর কাছে রূপকথার গুপ্তধনের মতো; কিন্তু না। হালিম বড়জোর দুই মিনিট স্তব্ধ হয়ে থাকলেন, পরমুহূর্তেই তাঁর মনে হলো, যাঁর জিনিস তাঁকে ফেরত দেওয়া দরকার। হালিম সঙ্গে সঙ্গে আরটিএতে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করলেন। তিনি দ্রুত ব্যাগটা কাছাকাছি কোনো থানায় পৌঁছে দিতে বললেন।
‘আমি থানার দিকে রওনা হলাম। এরই মধ্যে আমার কাছে থানা থেকে ফোন এল। আমার গাড়ির নম্বর জিজ্ঞাসা করল। বলল, “আপনি একটু থানায় আসেন।” আমি বললাম, দিরহামভর্তি ব্যাগের কথা বলবেন তো? আমি পেয়েছি। থানার দিকেই আসছি। তারা শুনে একরকম অবাকই হলো।’ বলছিলেন হালিম।

সততার পুরস্কার
হালিম ব্যাগসহ সবকিছু থানায় পৌঁছে দিলেন। থানায় বসেই তাঁরা গণনা করলেন। একটা নোটও এদিক-ওদিক হয়নি। সব মিলিয়ে নগদ দুই লাখ দিরহাম, আর প্রায় ১০ লাখ দিরহাম সমমূল্যের স্বর্ণালংকার ছিল ব্যাগের ভেতরে। সবকিছু ফেরত পেয়ে ব্যাগের মালিকের মুখটাও হয়েছিল দেখার মতো! দুবাইয়ের একটি পত্রিকার কাছে হালিম হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘তিনি খুশিতে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। নাচবেন না ডিগবাজি খাবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না।’
দুবাইয়ের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের লোকজন প্রশ্ন করেছেন, ‘এতগুলো দিরহাম হাতের কাছে পেয়েও তুমি কী ভেবে ফেরত দিয়ে দিলে?’ শুনে আমাদের হালিমের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘এটাই দুবাইয়ের ট্যাক্সিচালকদের নিয়ম।’
হালিমকে সততার পুরস্কার দিয়েছে আরটিএ কর্তৃপক্ষ। আরটিএর চেয়ারম্যান মাত্তার আল তায়ার নিজ হাতে হালিমের হাতে সনদ তুলে দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হালিফ আল রুমাইতি, জাবের আল-বাশার, চিফ ইন্সপেক্টর আবদুল আজিজ আল-সালেমিও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। মাত্তার আল তায়ার দুবাইয়ের পত্রিকাগুলোর কাছে বলেছেন, ‘আমরা তাঁকে (হালিম) নিয়ে খুবই গর্বিত।’ আব্দুল হালিম বললেন, ‘স্যার আমাকে বলেছেন, তুমি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের ধারণাই বদলে দিয়েছ।’
বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকায় উঠে এসেছে এই খবর। প্রতিটি খবরেই হালিমের নামের পাশে লেখা একটি শব্দে চোখ আটকে যায়—বাংলাদেশি! ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আমার দেশের কথাও বলে। এইটা খুব ভালো লাগে, ভাই।’ বলছিলেন হালিম। তিনি জানালেন, দুবাই এক্সিলেন্সি অ্যাওয়ার্ডের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করা হয়েছে। দুবাইয়ের শেখ প্রতিবছর একজনের হাতে এই অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন। তবে হালিমের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, মনের শান্তিটাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। ‘অনেকে বলে, তুমি তো টাকাটা নিয়ে নিতে পারতা। লুকায় ফেলতে পারতা। এসব করলে হয়তো বড়লোক হইতাম, কিন্তু ভাই, মনে তো শান্তি পাইতাম না। যাঁর টাকা তাঁরে ফিরায় দিছি। এখন দেখেন, কত ভালো আছি।’ হালিমের কণ্ঠে প্রশান্তি।
তথ্যসূত্র: এমিরেটস টোয়েন্টিফোর/ সেভেন, ইয়াহু নিউজ

গ্রামের নাম কালিন্দীপাড়া
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার কালিন্দীপাড়া গ্রাম। গ্রামের ঘরে ঘরে টেলিভিশন আছে, আছে স্যাটেলাইট সংযোগও। তবে মনু মিয়ার কথা আলাদা। মনু মিয়া বলছিলেন, ‘বাড়িতে ডিশ নাই। পোলারে নাকি টিভিতে দেখাইছে। আশপাশের মানুষজন কইছে। আমরা দেখতে পারি নাই। সবাই বলতেছে, আপনার ছেলে একটা ভালো কাজ করছে।’ হ্যাঁ, মনু মিয়াই আমাদের আব্দুল হালিমের বাবা। যে বাবা ছেলেকে ছোটবেলায় সৎ থাকতে শিখিয়েছেন, তাঁর আনন্দ আজ কতখানি? প্রশ্নের জবাব ইতিমধ্যেই একবার হালিমের কাছে পাওয়া হয়েছে, ‘ঘটনা যেদিন ঘটল, সেদিনই আমার স্ত্রীকে ফোন করছিলাম। আব্বা-আম্মার সঙ্গে কথা হইছে। তাঁরা খুব খুশি। আমি যে লোভ করি নাই, এইটাই আব্বা-আম্মার কাছে সবচেয়ে বড়।’ বাবা মনু মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে পাওয়া গেল একই সুর, ‘কী যে খুশি হইছি, বইলা প্রকাশ করতে পারব না।’ মনু মিয়া একসময় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ আর সিলেট ক্যাডেট কলেজে ঠিকাদারের কাজ করেছেন। এখন বয়স হয়েছে, সংসারের দায়িত্ব ছেলেদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ছেলে সততার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করছেন, বাবার চেয়ে খুশি আর কেই-বা হতে পারে।
আব্দুল হালিমের দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে আজমাইন জুহায়ের আনজুমের বয়স ছয়, আর সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়েটার নাম সামিয়া জারিন সারা। স্ত্রী কোহিনূর আক্তার কুমিল্লার একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। কুমিল্লায় কোহিনূরের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা চলছে। হালিমের বাড়ির সবার সঙ্গে যখন মুঠোফোনে কথা হচ্ছে, কোহিনূর গেছেন পরীক্ষা দিতে।
হালিমের এই অসাধারণ সততায় কে বেশি আনন্দিত—এই প্রতিযোগিতায় অবশ্য মনু মিয়ার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী শ্যামলা বেগম, আব্দুল হালিমের মা। বললেন, ‘আমরা দরিদ্র মানুষ। গরিবের তো সম্মানটাই সবচেয়ে বড়। টাকাপয়সা দিয়া কী হইব? ছেলে নিজের সম্মান রাখছে, আমাগো সম্মানও রাখছে। এইটাই বড়।’

No comments:

Post a Comment