Friday, July 5, 2013

খৈয়াছড়ার খোঁজে

1 / 8
দুর্গম অঞ্চল ছাড়াও এদেশের অনেক জায়গা আছে বেশ বিপজ্জনক। তারপরও দুঃসাহসীরা সেসব জায়গায় গিয়ে রোমাঞ্চের স্বাদ নেন। এ রকমই একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন ইনসাইটা ট্যুরিজমের পরিচালক এমএইচ জায়েদী। নিজেকে রোমাঞ্চপ্রিয় মনে করলে আপনিও সাহস করে ঘুরে আসতে পারেন।

 482
 2
 6      Print Friendly and PDF
আমাদের দেশে শীতকালই ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হিসেবে ধরা হয়। অথচ বর্ষায় প্রকৃতি হয় পূর্ণযৌবনা। আমাদের মতো ভ্রমণপ্রেমিরা বর্ষায় নিজেদের ঘরে আটকে রাখি না। ফেইসবুকের বেড়ানোবিষয়ক গ্রুপ ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’-এর সঙ্গী হয়ে ঘুরে এলাম বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ- মহামায়া ও খৈয়াছড়া ঝরনা।
অনেকের মতে সাতস্তরবিশিষ্ট খৈয়াছড়া বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ঝরনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়।
২৭ জুন রাত ১২টা, শাহবাগ ছবিরহাট।  ৫২ জন সফরসঙ্গীর সবাই সময়ের আগেই উপস্থিত। এদের মধ্যে আছেন মেডিকেলের ছাত্র মামুন, ব্যাংকার শিমুল ও তার স্ত্রী  ডাক্তার মৌরি। বন্ধুদের মধ্যে আছে ওসিংটং রিসোর্টের কর্ণধার মুস্তাফিজ, স্থপতি হাসিব ও হায়দারসহ আরও অনেকে।
ভ্রমণের জন্য একটি ৩২ সিটের বাসের পাশাপাশি আনা হয়েছে ১৪ সিটের ২টি মাইক্রোবাস। রাত ১২টায় রওনা হলাম। আমাদের বিদায় জানালেন ভ্রমণ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট টুটু। অসুস্থতার কারণে তিনি আমাদের সঙ্গে যেতে পারেননি।
বাস ছাড়তেই শুরু হল আড্ডা, হাসাহাসি আর আনন্দ। শিমুল আর মৌরির মতো কেউ কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। তবে আমাদের হৈচৈয়ের কারণে সেই চেষ্টা বৃথা গেল। রাত তিনটায় কুমিল্লা মহাসড়কের পাশে নূরজাহান রেস্তোরাঁয় আমাদের মাইক্রোবাস সবার আগে পৌঁছল।
বাইরে মুশলধারায় বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরেই অন্য বাসগুলোও চলে আসল। ভোর সাড়ে চারটায় আমাদের বাস রওনা হল বারইয়ারহাটের পথে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন তাসিন। এদিকে খবর এল, বড় বাস রাস্তায় নষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটি বাস ভাড়া করে চলে আসার জন্য ফোনেই বলা হল। সকাল ৮টায় বারইয়ারহাট পৌঁছে নাস্তা শেষ করেই মহামায়া দেখতে রওনা হলাম।
মহামায়া আসলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটা প্রজেক্ট। যেখানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে হ্রদ বানানো হয়েছে। সেঁচ কাজের জন্য ব্যবহার করা হয় এই পানি। লম্বায় প্রায় ১২ কিলোমিটার। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়, হ্রদের আশপাশে তেমন জনবসতি নেই।
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৮ নম্বর দুর্গাপুর ইউনিয়নের ঠাকুরদিঘি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক মহামায়া। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঠাকুরদিঘি থেকে দেড় কিলোমিটার আগে এই হ্রদের অবস্থান।
আশপাশের পাহাড়ি অংশগুলো দেখার মতো সুন্দর। আমরা যখন মহামায়তে পৌঁছুই, তখন রোদ ছিল, আকাশের পশ্চিম দিকে ছিল ঘনকালো মেঘ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামল ঝুপঝুপ করে। পাহাড়ি বৃষ্টির রোমাঞ্চ অবর্ণনীয়। সবাই মহানন্দে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। হ্রদে ঘোরার জন্য আগে থেকেই ফাইবার প্লাস্টিকের নৌকা ব্যবস্থা করা ছিল। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা নৌকায় উঠে রওনা হলাম।
অতল, গভীর হ্রদের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ভিজে বেড়াতে দারুণ লাগছিল। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ পানি পড়ার বুনো আওয়াজ কানে ভেসে এল। পাহাড়ের আড়াল থেকে নৌকা বের হয়ে আসতেই সবার মুখ থেকে একটিই আওয়াজ বের হয়ে আসল-- ‘ওয়াও’।
এখানে যে একটা ঝরনা আছে তা কেউই জানত না। সবাই অবাক! পরে বোঝা গেল আসলে বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল থেকেই এই ঝরনার জন্ম। কী তার ক্ষিপ্রতা! কী তার শব্দ! ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
যখন নৌকা থেকে ঝরনার পায়ের কাছে নামলাম তখন ভয়, ভালোলাগা আর উত্তেজনার অদ্ভুত আবেগের মিশ্রণ সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। ঠিক নিচে তুমুল স্রোতের জলাধারাটুকুতে ঝাঁপাঝাঁপি করা আর নিলাদ্রী অধরার পানিরোধী ক্যামেরায় ছবি তোলার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর মজাই ছিল অন্যরকম।
মহামায়া থেকে খৈয়াছড়ার দিকে যাত্রা শুরু করে একটা রেললাইনের সামনে এসে থামলাম। বাস ছেড়ে সেখান থেকে প্রায় সোয়া পাঁচ কিলোমিটারের পদযাত্রা শুরু হল। অর্থাৎ যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার দুর্গম পথ।
পায়ের তলায় প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা, হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি, স্রোতস্বিনী ঝিরি, রক্তপিপাসু জোঁকের মুহুর্মুহু আক্রমণ-- এসব উপেক্ষা করে ৫২ জনের দলটি একসঙ্গে এগুচ্ছিলাম ঝরনা দেখার উগ্র বাসনায়।
পাহাড়ি ঢলের কারণে বিরাট দলটির সবাই হাতে হাত ধরে মানব শিকল তৈরি করে বুঝেশুনে পা ফেলে এগুতে হচ্ছিল। প্রবল স্রোত ঠেলে যাচ্ছিলাম। কখনও পিচ্ছিল পাথরে, কখনও চোরা গর্তে। কখনও আবার লতাপাতায় পা আটকে যাচ্ছিল সবারই। পাশের সঙ্গী শক্ত করে ধরে রাখার কারণে পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে যাওয়া, কারও ডাকে বা জোঁকের কামড় খেয়ে আর্ত চিৎকার শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখা-- এভাবেই চলতে থাকলাম আমরা। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা!
তখন ঝরনার খুব কাছাকাছি আর একটু এগুলেই দেখা মিলবে কাঙ্ক্ষিত খৈয়াছড়া। এই সময় আবারও আকাশ কালো হয়ে মেঘ জমা শুরু হল। ঝরনার কাছাকাছি যেতে পানির উন্মত্ততা এত বেড়ে গেল যে দলনেতা মনা সবার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অভিযান শেষ করতে বাধ্য হলেন।
৫২ জনের মধ্যে অনেকেরই দুর্গম জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে। তারাও সবাই স্বীকার করল, পানির এমন উন্মত্ত রূপ কেউই দেখেনি।
ঝিরি দিয়ে নেমে আসা পানির মাতাল অবস্থা দেখে সবাই অনুভব করলাম ঝরনার কী অবস্থা হতে পারে। যারা একটু বেশি সাহসী তাদের মন খচখচ করতেই থাকল। এত কাছে এসে না দেখে চলে যাওয়াটা তাদের জন্য মহাকষ্টের বিষয়।
সকলের নিরাপত্তার কথা ভেবে অতৃপ্ত মন নিয়ে ফিরে এলাম। ভ্রমণবাংলা দলের মনা দলনেতা হিসেবে বেশ দায়িত্বশীল। আমাদের মনখারাপ অবস্থা দেখে তিনি বললেন, “আমরা একসঙ্গে ভ্রমণ আর অ্যাডভেঞ্চার করতে চাই। কাউকে হারাতে চাই না। হাসিবের চশমা বা তাহসিনের হারানো মোবাইল ফোন আমি হয়তো ফেরত দিতে পারব, তবে কারও প্রাণ গেলে আমি ফেরত দিতে পারব না।”
খৈয়াছড়া ঝরনাতে পানির প্রবল বেগ দেখে আমার মনটা কেঁপে উঠেছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। পাহাড়ের এমন ভয়ঙ্কর রূপ খুবই কমই দেখেছি। আমার গুরু হামিদভাই বলতেন “বিপদের মুখোমুখি হতে। তবে সেটা অবশ্যই হিসেব করে।”
ঝরনা দেখতে ব্যর্থ হলেও এতসব মজার ঘটনার কারণে সফরটা মোটেই ব্যর্থ মনে হয় না। তারপরও ভাবি আবার যাব, খৈয়াছড়া ঝরনার সঙ্গে দেখা করে আসবই।
কিছু তথ্য
ঢাকা থেকে ৫০ জনের যাতায়াত ও খাওয়াসহ খরচ পড়বে জনপ্রতি ২০০০ টাকা। এই ভ্রমণে রাতে থাকার কোনো ব্যাপার নেই। দুই রাত একদিনের সফরে দুটো রাতই যাওয়া আর আসাতে খরচ হয়ে যাবে। মাঝের দিনটি শুধু ঘোরাঘুরি।
এই এলাকা যেহেতু পানি মাড়িয়ে ঘুরতে হয়, সে জন্য অবশ্যই স্যান্ডেল পরে যাবেন।
পথে অনেক খাওয়ার হোটেল পড়বে। সেখানেই খেয়ে নিতে পারবেন। ভেজা জামাকাপড় বদলানোর জন্য পেট্রোল পাম্পের শৌচাগার ব্যবহার করা যায়।
সঙ্গে যা নেবেন
১. ব্যাগ। ২. গামছা। ৩. ছাতা। ৪. রেইনকোট। ৫. অতিরিক্ত এক সেট কাপড়। ৬. পানির বোতল ৭. টুথপেস্ট, সাবান, শ্যম্পু। ৮. স্যান্ডেল। ৯. ক্যামেরা, ব্যাটারি, চার্জার (যারা ছবি তুলতে পছন্দ করেন তাদের জন্য)। ১০. পলিথিন। ১১. সানক্যাপ বা টুপি। ১২. সানগ্লাস। ১৩. সানব্লক। ১৪. টিস্যু। ১৫. ব্যক্তিগত ওষুধ।

No comments:

Post a Comment