প্রিয় নুহাশ হুমায়ূন,
কেমন আছেন তা জানতে চাইবো না, কারণ খুব ভালো করে জানি আপনি ভালো নেই। সবাই খুব লিখছে আপনার বাবা হুমায়ূন আহমেদের কথা; যাঁর নামের আগে কোনো বিশেষণ লাগাতে হয় না, কেননা তাঁর নামটাই বাংলাদেশে একটি বিশেষণে পরিণত হয়েছে; কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি ও আপনার পরিবার বাদ পড়ে যাচ্ছেন আমাদের যাবতীয় আলোচনা-পরিসর থেকে। এটা সম্ভবত উচিত না। তাই এই খোলা চিঠি লিখছি আপনাকে, যদিও জানি না আপনি কোনোদিন পড়বেন কিনা!
আপনার বাবাকে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আমি শহীদমিনারে যাইনি নুহাশ, যদিও আমার বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয় শহীদমিনার। আমার কৈশোরে আমি আপনার বাবার মুখোমুখি হয়েছি একরাশ নিঃসঙ্গতা নিয়ে, এবং এই ব্যাপারটা আমার মতন অনেকের ক্ষেত্রেই হয়তো সত্য; কারণ কৈশোরিক নিঃসঙ্গতা দূর করবার একটা আশ্চর্য কৌশল জানতেন আপনার বাবা। তাই একা একা নিজের ঘরে বসে থেকে অনেকক্ষণ ভেবেছি আপনার বাবার কথা, ঠিক যেমন করে একটা সময় তার বই পড়তাম। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের মতন আমিও চোখ রেখেছি টেলিভিশনের পর্দায়। আপনাকে দেখছিলাম, আপনার পরিবারটাকে দেখছিলাম। আপনার শোকে-পাথর-হয়ে-যাওয়া অভিব্যক্তিহীন মুখ দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, আপনার বড় বোন শীলা আহমেদের চোখেমুখে ফুটে ওঠা অসহনীয় অসহায়তা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ‘আগুনের পরশমণি’ ও ‘আজ রবিবার’-এর কারণে শীলা আহমেদের অভিনয় প্রতিভার অনুরাগী হয়েছিলাম আমি আমার ছেলেবেলায়, সেই অনুরাগ আজো অটুট। আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল আমি তাকিয়ে আছি আপনার বাবার লেখা কোনো উপন্যাসের আবেগময় দৃশ্যকল্পের দিকে। কিন্তু জানি এটা কোনো উপন্যাসের দৃশ্যকল্প নয়, এটা জীবনের বাস্তবদৃশ্য, এবং অত্যন্ত নির্মম একটি বাস্তবদৃশ্য। তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না নুহাশ, একটুও না... আপনার ও আপনার বোনদের জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছিল। কেন? আপনারা যদি ‘তেমন কেউ চেনে না, জানে না’ এমন কোনো মানুষের সন্তান হতেন, তাহলে আপনাদের বাবার প্রাণহীন শরীরের পাশে বসে চিৎকার করে কাঁদতে পারতেন। কোনো ফুলের কৃত্রিম স্তবক আপনাদের অশ্রুঅংশীদার হতে চাইতো না, কোনো লাইভ টেলিকাস্ট আপনাদের সহ্য করতে হতো না। কিন্তু বিখ্যাত বাবার সন্তান হওয়ার কারণে সেই সহজ কান্নার সুযোগ আপনারা পেলেন না। খ্যাতি হয়তো মানুষকে লাখো মানুষের কাছে নিয়ে যায়, কিন্তু দূরে নিয়ে যায় আপন মানুষ’দের কাছ থেকেই! জানি বাংলাসাহিত্যের অন্য সব লেখকের মতন আপনার বাবার লেখাপত্রেরও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কে আর সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে, বলেন? সেইসব সীমাবদ্ধতার সুনির্দিষ্ট সাহিত্যভিত্তিক সমালোচনা খালেদ হোসাইন স্যার করেছেন, করেছেন আহমাদ মোস্তফা কামাল; হয়তো আরো অনেকেই করেছেন। কিন্তু সমালোচনার নামে উল্টোপাল্টা কথা লিখে তাকে হেয় করার অসাহিত্যিক অপচেষ্টাও কম হয়নি, সম্ভবত এমন সব অসমালোচনাই হয়েছে বেশি। ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়’- এটা শুধু প্রমথ চৌধুরীদের যুগেই নয়, সব যুগেই সত্য। আপনার বাবার লেখালেখির সমালোচনা এই অধমও করেছি আমার অতিসীমিত পরিসরে, ফেসবুকে-ব্লগে বা বন্ধুআড্ডায়। কিন্তু কখনোই আপনার বাবাকে ব্যাক্তিগতভাবে শত্রু মনে করিনি, প্রশ্নই আসে না, হুমায়ূন আহমেদের মত মানুষ কারো ব্যক্তিগত শত্রু হতে পারেন এটা আমি বিশ্বাসই করি না। সুতরাং সবসময়ই সমালোচনার ভিত্তি ছিল তার সাহিত্যকর্ম বা কোনো বিশেষ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য। খুব বেশি ভালোবাসতাম আপনার বাবাকে, তাই যখন দেখতাম তিনি তাঁর অসামান্য প্রতিভা নষ্ট করছেন কোনো তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের বই লিখে, তখন প্রচণ্ড রাগ হত। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, এইসব দিনরাত্রি, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, ইরিনা, অনন্ত নক্ষত্রবীথি, ফিহা সমীকরণ, শূন্য, তোমাদের এই নগরে, সৌরভ, কবি, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, এই বসন্তে, মেঘের ছায়া, চোখ, ময়ূরাক্ষী, পাখি আমার একলা পাখি, নক্ষত্রের রাত, আজ আমি কোথাও যাবো না, বৃষ্টি বিলাস, কোথাও কেউ নেই, শ্রাবণ মেঘের দিন, নীল হাতি, পিপলী বেগম, তারা তিনজন, কে কথা কয়, নির্বাসন, অচিনপুর, গৌরীপুর জংশন, ছোট মামা ও রাজকুমারী সুবর্ণরেখা- এবং এরকম আরো অসাধারণ হৃদয়স্পর্শী অজস্র উপন্যাস, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও ছোটগল্প যাঁর হাত থেকে বেরিয়েছে তিনি যদি ‘আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি’ জাতীয় সাহিত্যমূল্যহীন বই লেখেন, রাগ হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়? যাঁকে ভালোবাসি তাঁর কোনো কথায় বা কাজে কষ্ট পেলে সেটার প্রকাশটাও জোরালো হয় সাধারণত। কিন্তু নুহাশ, আমাদের সেই সত্যনিষ্ঠ সমালোচনা অনেকের মেকি প্রশংসার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। আপনার বাবার সবচেয়ে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি লিখে গেছেন নিরবচ্ছিন্ন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, তোয়াক্কা করেননি কারো ভালো লাগা খারাপ লাগার। এটাই হয়তো তাঁর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। কিংবা কে জানে, সবচেয়ে বড় শক্তিমানতা! জানি না, এখন এসব নিয়ে কথা বলা অর্থহীন বলে মনে হয়... নুহাশ, আমরা যারা আশি বা নব্বইয়ের দশকে মধ্যবিত্ত কাঠামোয় বড় হয়েছি এবং সুযোগ পেয়েছি ‘আউটবই’ পড়ার; তাদের প্রায় সবাই কখনো না কখনো হিমু হতে চেয়েছিলাম, বা মিসির আলী, বা শুভ্র, বা বাকের ভাই, বা মজনু, বা রূপা, বা...। আমি অনেকদিন আমার কৈশোরে, কোনো বৃষ্টিশেষের সন্ধ্যাবেলায়, কোনো বহুতল ভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময়, সেই ভবনের তিন চার বা পাঁচ তলার বারান্দায়, আধো আলো আধো অন্ধকারে দাঁড়ানো বাতাসে-চুল-ওড়া মেয়েটিকে দেখে তাকে ‘রূপা’ ভেবে শিহরিত হয়েছি। আমি কখনোই হিমু হতে চাই নাই, ‘বাদল’ হতে চেয়েছিলাম; যে তার ‘হিমুদা’র প্রতিটি কথায় বা কাজে মুগ্ধ হবে। কিন্তু সেই ‘হিমুদা’কে বাস্তবে পাওয়া যায় নি, যায় না। তন্দ্রাবিলাস পড়ে বহুদিন আমি ফারজানার মত সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হতে চেয়েছি, ভেবেছি আমার বাবাও একদিন বিমানে বড় চাকরি করবেন আর দেশবিদেশ থেকে আমার জন্য মজার মজার আইসক্রিম আনবেন! কবি পড়েই প্রথম সিদ্ধান্ত নিয়েছি কবিতা লেখার, চেয়েছি আতাহারের মত জ্বরের ঘোরেও আবৃত্তি করে যেতে শুধুই কবিতা! জানি না এখন যারা বড় হচ্ছে তারা কেউ হিমু/মিসির আলী/শুভ্র/রূপা/বাদল হতে চায় কিনা! সেইসব দিনরাত্রির সরল মুগ্ধতা আমার কৈশোরস্মৃতির সুন্দরতম অংশ হয়ে আছে! নুহাশ, কথা ছিল আপনার আর আপনার পরিবারের কথা লিখব, কিন্তু এখন পড়তে গিয়ে দেখি লেখা হল আপনার বাবার কথাই। আসলে হুমায়ূন আহমেদ মানুষটাই এত অসাধারণ যে যেখান থেকেই শুরু করি তার কথা চলে আসে, অবশ্য সেটাই তো হওয়ার কথা! আমার খুব ইচ্ছা ছিল আপনার বাবার সাথে দেখা করার, তার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখার, যে হাতের স্পর্শ লেগে আছে আমার এবং আমাদের কাতর কৈশোরের স্বাপ্নিক সময়ে। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছা ঈশ্বর পূরণ করেন নাই। এখন আমার খুব ইচ্ছা আপনার সাথে দেখা করার, আপনার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখার। তাহলে অন্তত এটুকু সান্ত্বনা নিজেকে দিতে পারবো যে হুমায়ূনের হাত না হোক, যার শরীরে বয়ে যাচ্ছে হুমায়ূনের রক্ত, তার হাতটা তো ছুঁতে পেরেছি! জানি না আমার এই ইচ্ছা পূরণ হবে কিনা... নুহাশ, আপনার পরিবারের প্রতি রইল আমার হৃদয়ের সেই অংশ থেকে অনন্ত ভালোবাসা ও অশেষ সহমর্মিতা যে অংশ একসময় আলোকিত হয়েছিল আপনারই বাবার লেখাপত্র পড়ে!
নিত্য শুভকামনায়
ইরফানুর রহমান রাফিন ২৩ জুলাই জিগাতলা, ঢা |
Monday, July 8, 2013
নুহাশ হুমায়ূনের কাছে খোলা চিঠি
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment