নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে দেশের প্রধান দুই দলের কথাবার্তায় তাঁরা সরকারে আছেন, নাকি বাইরে আছেন সে বিবেচনাটিই মুখ্য থাকে। সরকারের বাইরে থাকলেই দল দুটি তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার দাবিতে ৫৬ হাজার বর্গমাইল তোলপাড় করে ফেলছে। আর সরকারে থাকলে ব্যবস্থাটির বিরুদ্ধে একটানা কথা বলছে। এ রকম চলছে ১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে। দেখেশুনে মনে হয়, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা-অপ্রয়োজনীয়তা যাচাই করে অবস্থান নেওয়ার পরিবর্তে, পরস্পরের প্রতি অসম্ভব মাত্রার অবিশ্বাস হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাসংক্রান্ত অবস্থান গ্রহণ ও সময়ে সময়ে অবস্থান পরিবর্তনের ভিত্তি। বারবার অবস্থান পরিবর্তনের বাস্তব ভিত্তি হয়তো আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনারও দরকার আছে। তবে এ লেখা তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রধান দুই দলের বারবার পরিবর্তিত হওয়া অবস্থান সম্পর্কে নয়।
এ লেখায় নিরবচ্ছিন্নভাবে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নেওয়া ঢাকার সুশীল সমাজের প্রভাবশালী অংশটির যুক্তিগুলো বুঝতে চাওয়া হয়েছে। আগের বছরগুলোর কথা বাদ দিলেও, ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে সুশীল সমাজের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাবিষয়ক কথাবার্তা বোঝার চেষ্টা করাটা খুব জরুরি। ২০১১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে জাতীয় সংসদ ২৯১-১ ভোটে ব্যবস্থাটিকে বিলুপ্ত করে। দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের দুই বাহু অর্থাৎ বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করার শক্তি আছে আমাদের সুশীল সমাজের। সরকারপ্রধান, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাধারী সরকারি দলের অবস্থানের সঙ্গেও সোচ্চারে দ্বিমতের শক্তি অর্জন করেছে বাংলাদেশি সুশীল সমাজ। বিকাশমান বুর্জোয়া গণতন্ত্রের জন্য এটি উল্লেখযোগ্য সুসংবাদ।
এক্ষণে বোঝার বিষয় হচ্ছে, ঢাকার সুশীল সমাজের প্রভাবশালী অংশটি কেন তত্ত্বাবধায়ক চায়। যতদূর বোঝা যায়, তত্ত্বাবধায়ক চাইতে গিয়ে তাঁরা ধরে নিয়েছেন যে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন বলতে জাতীয় নির্বাচন। এ ধরে নেওয়াটাই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নানাভাবে ব্যাখ্যাত হচ্ছে। এ ধরে নেওয়ার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিক, রাজনৈতিক দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে সর্বোচ্চ মাত্রার প্রত্যাখ্যান এটি। নিয়মিত বিরতিতে শাসক বাছাই ও ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। আর নির্বাচন হচ্ছে এই শর্ত পূরণের উপায়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দুনিয়ায় যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরাই নির্বাচন পরিচালনা করেন; জিতলে থেকে যান, হারলে বিদায় নেন। এ নিয়ে কোথাও কথা ওঠে না। বাংলাদেশে প্রচণ্ডভাবে কথা উঠেছে সুশীল সমাজের প্রভাবশালী অংশটির দিক থেকে। একে গুরুত্ব না দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, রাষ্ট্র বা সরকারের করণীয়-বর্জনীয় কিংবা এখতিয়ারের সীমানা মূলত সুশীল সমাজই ক্রমাগত গড়ে ও ভাঙে। এখন কথা হচ্ছে, সুশীল সমাজ যেমন প্রশ্ন তুলতে পারে, তেমনি সুশীল সমাজের তোলা প্রশ্নকেও প্রশ্ন করতে পারে জনগণ। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে এমন একটি প্রশ্ন হতে পারে: দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না মর্মে ধরে নেওয়ার পক্ষে আমাদের হাতে কী কী যুক্তি বা প্রমাণ আছে? বাংলাদেশে কয়টি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে? দলীয় সরকারগুলো কতবার ব্যর্থ হওয়ার পরে এমন একটি গুরুতর সিদ্ধান্তে পৌঁঁছানো হচ্ছে? একানব্বই থেকে নির্বাচন হচ্ছে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে; এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো দায়িত্ব বা কৃতিত্ব দলীয় সরকারের নেই। এর আগে পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত সামরিক শাসন। প্রশ্ন হচ্ছে, সামরিক শাসনামলের নির্বাচনগুলোকেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বলা হবে কি না? যদি কেউ তা বলতে চান, তাহলে তাদের একই সঙ্গে সামরিক শাসনকেও বৈধ বলতে হবে। আরও বলতে হবে যে দলীয় সরকার বলতে একটা দল থাকাই বোঝায়; এ দল কীভাবে গঠিত হয়েছে, কীভাবে ক্ষমতায় এসেছে, সেসব বিবেচ্য নয়। তত্ত্বাবধায়কপন্থী সুশীল সমাজের দিক থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য আসা দরকার।
বাস্তবতা হলো, নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে বলতে গেলে টেনেটুনে দুটি। প্রথমটি ১৯৭৩ সালে; দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। কেউ বলবে না যে নির্বাচনটি সর্বাংশে সুষ্ঠু হয়েছিল। কিন্তু এ কথা কি বলা সম্ভব যে ওই নির্বাচনে যাঁদের জয়ী হওয়ার কথা ছিল তাঁরা জয়ী হননি? কোনো গবেষক এমন দাবি তোলেননি। দলীয় সরকারের অধীনে আরেকটি নির্বাচন হয়েছে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি বিধায় এ নির্বাচনের ফলাফল সর্বমহল থেকে প্রত্যাখ্যাত এবং মূল্যহীন হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৭৩ এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ মাথায় রেখেই কি তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে? তত্ত্বাবধায়কপন্থী সুশীল সমাজের অজস্র লেখালেখি, টক শো, সভা-সেমিনার থেকে কিন্তু প্রমাণ মেলে না। সুনির্দিষ্টভাবে এ দুই নির্বাচনে দলীয় সরকারের ‘ব্যর্থতা’ চিহ্নিত করে দলীয় সরকারের হাত থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়ার যুক্তি বিস্তার করতে তত্ত্বাবধায়কপন্থী সুশীল সমাজকে দেখা যায় না। তেমন কিছু যদি হতো, তাহলেও প্রশ্ন থাকত। মাত্র দুটি নির্বাচন যাচাই করে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচিত দলীয় সরকারগুলো কোনোভাবেই সক্ষম নয় মর্মে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া যায়? ‘চিলে কান নিয়েছে’র মতো একটা ব্যাপার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে না কি? কিংবা ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’? উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত-প্রমাণাদি ছাড়া বেচারা দলীয় সরকারগুলো ‘চিল’ কিংবা ‘নন্দ ঘোষ’ হয়ে যাচ্ছে না তো?
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পক্ষে আরেকটা কড়া যুক্তি হচ্ছে ‘বিদ্যমান বাস্তবতা’। কী এ ‘বিদ্যমান বাস্তবতা’? তত্ত্বাবধায়কপন্থীদের মতে, বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতার অসহনীয় অভাব বিরাজ করছে। কথা সত্য। কিন্তু বিদ্যমান এ বাস্তবতা অতিক্রমের জন্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষ দরকার; এ ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর যৌক্তিকতা এত দিনেও স্পষ্ট হচ্ছে না। আমাদের মনে হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করার সর্বতো প্রয়াস নেওয়া। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ, রেডিও-টিভিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা। ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে বিরোধীদের মধ্যে বিরাজমান কারণ-অকারণ ভীতিগুলো দূর হওয়ার ব্যবস্থা করা; সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনে ‘মঙ্গল গ্রহ থেকে’ পর্যবেক্ষক আনা।
মোট কথা, সারা দুনিয়ায় উদারনৈতিক গণতন্ত্র যে প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েছে সেগুলোতেই মনোযোগী থাকাটা দরকার। গণতন্ত্র চাইলে গণতন্ত্রের শর্তগুলো মান্য করতে হবে তো! আসল কথা হচ্ছে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে বাঁচানো এবং এগিয়ে নেওয়া। এর জন্য কেউ চান বা না চান রাজনৈতিক দল লাগবে, রাজনীতিক লাগবে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসনকারী বেছে নেওয়ার জন্য এগুলো হচ্ছে অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদান। তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তিগুলোর মধ্যে একদল ‘সুপারম্যান’-এর জন্য আকুতি লক্ষ করা যায়। এ ‘সুপারম্যান’রা, বলা হয় আমাদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেন। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলীয় সরকারের সামর্থ্য সেভাবে পরীক্ষা না করেই চলছে অনির্বাচিত বেসামরিক ‘সুপারম্যানদের’ জন্য বন্দনা। কেন?
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলার সময় কেউ কেউ মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, গ্রিস ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের নাম টানেন। কথা হচ্ছে, মালয়েশিয়া কিংবা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান কি আমাদের ধারে-কাছে আসে? জাতীয়তাবাদী দেমাগ দেখানো ঠিক নয়; কিন্তু তাই বলে সব সময় নিজেদের ছোট ভাবাটাও ঠিক নয়। সবকিছু ভেঙে পড়তে থাকা পাকিস্তান আমাদের উদাহরণ হতে পারে কি? মালয়েশিয়ায় তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে পরিচালিত হবে তার কোনো সাংবিধানিক রূপরেখাই নেই। অস্ট্রেলিয়ায় কী হয়? তত্ত্বাবধায়কের বাংলাদেশি মডেলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মডেলের কোনো মিল নেই। সেখানে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দলীয় সরকারই তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে; নির্বাচন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত। গ্রিস, সবাই জানে, অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের বিশেষ এক সময়ে গত বছর তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বেছে নেয়। পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদিভূমি গ্রিসে এ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন থাকবে মনে করার কারণ নেই। আরেকটি কথা হচ্ছে, গ্রিসে যে তত্ত্বাবধায়ক ক্যাবিনেট গঠিত হয়েছিল, তাতে কিন্তু দলীয় লোকজনকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, তারা রাজনীতিকদের নির্বাচন পরিচালনা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পথে যায়নি। গত বছর তত্ত্বাবধায়ক এসেছে মিলিটারি ও মৌলবাদী-আক্রান্ত দেশ মালিতে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক ক্যাবিনেটের ৩১ সদস্যের মধ্যে পাঁচজন এসেছেন বছরের শুরুতে ক্যুকারী ব্যক্তির পছন্দে। মালিতেও ব্যবস্থাটির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। মোট কথা, আরও কোনো কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা থাকার যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশে এ ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানোর খুব একটা শক্তিশালী যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না।
আমরা এটুকু বুঝি, উদারনৈতিক গণতন্ত্র চাইলে মূলধারার বেশির ভাগ রাজনীতিকের যাবতীয় কীর্তিকলাপ মাথায় রেখেও দুনিয়াব্যাপী যুগ যুগ ধরে পরীক্ষিত পদ্ধতিগুলোকে ধরেই এগোতে হবে। সামনের নির্বাচন কীভাবে হবে, তা স্পষ্ট নয়। এটা নির্ভর করছে প্রধান দুই দলের শক্তিমত্তার ওপরে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক সওয়াল করার সময় এটা মনে রাখা খুব দরকার যে কিছু রাজনীতিকের ওপর বিরক্ত হয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষের হাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তুলে দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
এ লেখায় নিরবচ্ছিন্নভাবে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নেওয়া ঢাকার সুশীল সমাজের প্রভাবশালী অংশটির যুক্তিগুলো বুঝতে চাওয়া হয়েছে। আগের বছরগুলোর কথা বাদ দিলেও, ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে সুশীল সমাজের তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাবিষয়ক কথাবার্তা বোঝার চেষ্টা করাটা খুব জরুরি। ২০১১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে জাতীয় সংসদ ২৯১-১ ভোটে ব্যবস্থাটিকে বিলুপ্ত করে। দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের দুই বাহু অর্থাৎ বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করার শক্তি আছে আমাদের সুশীল সমাজের। সরকারপ্রধান, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাধারী সরকারি দলের অবস্থানের সঙ্গেও সোচ্চারে দ্বিমতের শক্তি অর্জন করেছে বাংলাদেশি সুশীল সমাজ। বিকাশমান বুর্জোয়া গণতন্ত্রের জন্য এটি উল্লেখযোগ্য সুসংবাদ।
এক্ষণে বোঝার বিষয় হচ্ছে, ঢাকার সুশীল সমাজের প্রভাবশালী অংশটি কেন তত্ত্বাবধায়ক চায়। যতদূর বোঝা যায়, তত্ত্বাবধায়ক চাইতে গিয়ে তাঁরা ধরে নিয়েছেন যে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন বলতে জাতীয় নির্বাচন। এ ধরে নেওয়াটাই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নানাভাবে ব্যাখ্যাত হচ্ছে। এ ধরে নেওয়ার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিক, রাজনৈতিক দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে সর্বোচ্চ মাত্রার প্রত্যাখ্যান এটি। নিয়মিত বিরতিতে শাসক বাছাই ও ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। আর নির্বাচন হচ্ছে এই শর্ত পূরণের উপায়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দুনিয়ায় যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরাই নির্বাচন পরিচালনা করেন; জিতলে থেকে যান, হারলে বিদায় নেন। এ নিয়ে কোথাও কথা ওঠে না। বাংলাদেশে প্রচণ্ডভাবে কথা উঠেছে সুশীল সমাজের প্রভাবশালী অংশটির দিক থেকে। একে গুরুত্ব না দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, রাষ্ট্র বা সরকারের করণীয়-বর্জনীয় কিংবা এখতিয়ারের সীমানা মূলত সুশীল সমাজই ক্রমাগত গড়ে ও ভাঙে। এখন কথা হচ্ছে, সুশীল সমাজ যেমন প্রশ্ন তুলতে পারে, তেমনি সুশীল সমাজের তোলা প্রশ্নকেও প্রশ্ন করতে পারে জনগণ। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে এমন একটি প্রশ্ন হতে পারে: দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না মর্মে ধরে নেওয়ার পক্ষে আমাদের হাতে কী কী যুক্তি বা প্রমাণ আছে? বাংলাদেশে কয়টি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে? দলীয় সরকারগুলো কতবার ব্যর্থ হওয়ার পরে এমন একটি গুরুতর সিদ্ধান্তে পৌঁঁছানো হচ্ছে? একানব্বই থেকে নির্বাচন হচ্ছে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে; এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো দায়িত্ব বা কৃতিত্ব দলীয় সরকারের নেই। এর আগে পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত সামরিক শাসন। প্রশ্ন হচ্ছে, সামরিক শাসনামলের নির্বাচনগুলোকেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বলা হবে কি না? যদি কেউ তা বলতে চান, তাহলে তাদের একই সঙ্গে সামরিক শাসনকেও বৈধ বলতে হবে। আরও বলতে হবে যে দলীয় সরকার বলতে একটা দল থাকাই বোঝায়; এ দল কীভাবে গঠিত হয়েছে, কীভাবে ক্ষমতায় এসেছে, সেসব বিবেচ্য নয়। তত্ত্বাবধায়কপন্থী সুশীল সমাজের দিক থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য আসা দরকার।
বাস্তবতা হলো, নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে বলতে গেলে টেনেটুনে দুটি। প্রথমটি ১৯৭৩ সালে; দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। কেউ বলবে না যে নির্বাচনটি সর্বাংশে সুষ্ঠু হয়েছিল। কিন্তু এ কথা কি বলা সম্ভব যে ওই নির্বাচনে যাঁদের জয়ী হওয়ার কথা ছিল তাঁরা জয়ী হননি? কোনো গবেষক এমন দাবি তোলেননি। দলীয় সরকারের অধীনে আরেকটি নির্বাচন হয়েছে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি বিধায় এ নির্বাচনের ফলাফল সর্বমহল থেকে প্রত্যাখ্যাত এবং মূল্যহীন হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৭৩ এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ মাথায় রেখেই কি তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে? তত্ত্বাবধায়কপন্থী সুশীল সমাজের অজস্র লেখালেখি, টক শো, সভা-সেমিনার থেকে কিন্তু প্রমাণ মেলে না। সুনির্দিষ্টভাবে এ দুই নির্বাচনে দলীয় সরকারের ‘ব্যর্থতা’ চিহ্নিত করে দলীয় সরকারের হাত থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়ার যুক্তি বিস্তার করতে তত্ত্বাবধায়কপন্থী সুশীল সমাজকে দেখা যায় না। তেমন কিছু যদি হতো, তাহলেও প্রশ্ন থাকত। মাত্র দুটি নির্বাচন যাচাই করে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচিত দলীয় সরকারগুলো কোনোভাবেই সক্ষম নয় মর্মে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া যায়? ‘চিলে কান নিয়েছে’র মতো একটা ব্যাপার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে না কি? কিংবা ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’? উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত-প্রমাণাদি ছাড়া বেচারা দলীয় সরকারগুলো ‘চিল’ কিংবা ‘নন্দ ঘোষ’ হয়ে যাচ্ছে না তো?
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পক্ষে আরেকটা কড়া যুক্তি হচ্ছে ‘বিদ্যমান বাস্তবতা’। কী এ ‘বিদ্যমান বাস্তবতা’? তত্ত্বাবধায়কপন্থীদের মতে, বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতার অসহনীয় অভাব বিরাজ করছে। কথা সত্য। কিন্তু বিদ্যমান এ বাস্তবতা অতিক্রমের জন্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষ দরকার; এ ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর যৌক্তিকতা এত দিনেও স্পষ্ট হচ্ছে না। আমাদের মনে হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করার সর্বতো প্রয়াস নেওয়া। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ, রেডিও-টিভিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা। ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে বিরোধীদের মধ্যে বিরাজমান কারণ-অকারণ ভীতিগুলো দূর হওয়ার ব্যবস্থা করা; সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনে ‘মঙ্গল গ্রহ থেকে’ পর্যবেক্ষক আনা।
মোট কথা, সারা দুনিয়ায় উদারনৈতিক গণতন্ত্র যে প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েছে সেগুলোতেই মনোযোগী থাকাটা দরকার। গণতন্ত্র চাইলে গণতন্ত্রের শর্তগুলো মান্য করতে হবে তো! আসল কথা হচ্ছে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে বাঁচানো এবং এগিয়ে নেওয়া। এর জন্য কেউ চান বা না চান রাজনৈতিক দল লাগবে, রাজনীতিক লাগবে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসনকারী বেছে নেওয়ার জন্য এগুলো হচ্ছে অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদান। তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তিগুলোর মধ্যে একদল ‘সুপারম্যান’-এর জন্য আকুতি লক্ষ করা যায়। এ ‘সুপারম্যান’রা, বলা হয় আমাদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেন। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলীয় সরকারের সামর্থ্য সেভাবে পরীক্ষা না করেই চলছে অনির্বাচিত বেসামরিক ‘সুপারম্যানদের’ জন্য বন্দনা। কেন?
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলার সময় কেউ কেউ মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, গ্রিস ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের নাম টানেন। কথা হচ্ছে, মালয়েশিয়া কিংবা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান কি আমাদের ধারে-কাছে আসে? জাতীয়তাবাদী দেমাগ দেখানো ঠিক নয়; কিন্তু তাই বলে সব সময় নিজেদের ছোট ভাবাটাও ঠিক নয়। সবকিছু ভেঙে পড়তে থাকা পাকিস্তান আমাদের উদাহরণ হতে পারে কি? মালয়েশিয়ায় তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে পরিচালিত হবে তার কোনো সাংবিধানিক রূপরেখাই নেই। অস্ট্রেলিয়ায় কী হয়? তত্ত্বাবধায়কের বাংলাদেশি মডেলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মডেলের কোনো মিল নেই। সেখানে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দলীয় সরকারই তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে; নির্বাচন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত। গ্রিস, সবাই জানে, অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের বিশেষ এক সময়ে গত বছর তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বেছে নেয়। পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদিভূমি গ্রিসে এ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন থাকবে মনে করার কারণ নেই। আরেকটি কথা হচ্ছে, গ্রিসে যে তত্ত্বাবধায়ক ক্যাবিনেট গঠিত হয়েছিল, তাতে কিন্তু দলীয় লোকজনকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, তারা রাজনীতিকদের নির্বাচন পরিচালনা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পথে যায়নি। গত বছর তত্ত্বাবধায়ক এসেছে মিলিটারি ও মৌলবাদী-আক্রান্ত দেশ মালিতে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক ক্যাবিনেটের ৩১ সদস্যের মধ্যে পাঁচজন এসেছেন বছরের শুরুতে ক্যুকারী ব্যক্তির পছন্দে। মালিতেও ব্যবস্থাটির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। মোট কথা, আরও কোনো কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা থাকার যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশে এ ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানোর খুব একটা শক্তিশালী যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না।
আমরা এটুকু বুঝি, উদারনৈতিক গণতন্ত্র চাইলে মূলধারার বেশির ভাগ রাজনীতিকের যাবতীয় কীর্তিকলাপ মাথায় রেখেও দুনিয়াব্যাপী যুগ যুগ ধরে পরীক্ষিত পদ্ধতিগুলোকে ধরেই এগোতে হবে। সামনের নির্বাচন কীভাবে হবে, তা স্পষ্ট নয়। এটা নির্ভর করছে প্রধান দুই দলের শক্তিমত্তার ওপরে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক সওয়াল করার সময় এটা মনে রাখা খুব দরকার যে কিছু রাজনীতিকের ওপর বিরক্ত হয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষের হাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তুলে দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
No comments:
Post a Comment