Monday, June 24, 2013

দেহে রোগ থাকলে মনে তার প্রভাব পড়ে আবার একই ভাবে মনে রোগ থাকলে দেহে তার প্রভাব পড়ে । ত্বকের ক্ষেত্রেও কথাটি ঠিক । অর্থাৎ ত্বকে রোগ থাকলে মনে তার প্রভাব পড়বে । আবার একই ভাবের মনে রোগ থাকলে তার প্রভাব ত্বকে পড়বে । মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আজ বরং একটা প্রশ্ন দিয়েই শুরু করছি, আচ্ছা বলুন তো,দেহের সবচেয়ে বড় অংগ কোনটি ? আগে জানা না থাকলে আপনি এই প্রশ্নের উত্তরটি শুনলে বেশ অবাকই হবেন হয়ত । হ্যাঁ, দেহের সবচেয়ে বড় অংগটি হলো দেহ-ত্বক বা সচরাচর আমরা যাকে চামড়া বলে থাকি । ত্বক নিয়ে আমরা যাই ভাবি না কেনো এর গুরুত্ব যে অপরিসীম সে কথা অস্বীকার করার কোনোই জো নেই । দেহের অভ্যন্তরে যা কিছু আছে সবই ত্বক আবৃত করে রাখে এবং একই সাথে সে গুলোকে রক্ষা করে থাকে । ত্বক না থাকলে আমাদের পেশী, হাড় সহ অন্যান্য অংগ-প্রত্যংগ ঝুলে থাকত । ত্বক যে এ সব কিছুকে আবৃত করে রাথে তাই নয় বরং আরো তিনটি কাজ করে ।

ত্বক দেহকে রক্ষা করে, দেহযন্ত্রের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রাখে এবং ত্বকের কারণেই দেহে আমাদের স্পর্শের অনুভূতি সৃষ্টি করে । এ ছাড়া আমরা অনেকেই জানি যে ত্বকের তিনটি স্তর রয়েছে । ত্বকের এই বর্হির অংশকে এপিডারমিস বলা হয় । ত্বকের যে অংশটি আমরা খালি চোখে দেখতে পাই তাই হলো এপিডারমিসের তলায় প্রতিনিয়ত নতুন ত্বক কোষরাজি গঠিত হচ্ছে ।
গঠন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর নতুন ত্বক কোষগুলো বর্হিমুখী যাত্রা শুরু করে । অর্থাৎ এপিডারমিসের উপেরর দিকে গমন করতে থাকে । এই যাত্রা শেষ হতে ২ সপ্তা থেকে এক মাস লেগে যায় । নদীর এ পাড় ভাংগে ওপাড় গড়ে বলে একটি প্রবাদ আমরা অহরহ বলে থাকি । দেহের ত্বক কোষের ক্ষেত্রেও এ রকম কান্ড প্রতিনিয়তই ঘটছে । নতুন ত্বক কোষ যখন উপরের দিকে আসতে শুরু করে তখন পুরান ত্বক কোষগুলো মরে যেতে থাকে । কাজেই এপিডারমিসের বাইরের অংশ প্রকৃতপক্ষে মৃত ত্বক কোষ ছাড়া আর কিছুই নয় । এই মৃত ত্বক-কোষগুলো বেশ মজবুত হয় বলে তারা দেহকে রক্ষা করতে পারে । তবে এ সব মৃত ত্বক কোষ দেহে মাত্র কয়েক দিন থাকে তারপর ঝরে যায় । দেহ থেকে কি পরিমাণ ত্বক কোষ ঝরে পড়ছে তার একটা হিসেব দিচ্ছি । প্রতি মিনিটে দেহ থেকে ত্রিশ হতে ৪০ হাজার মৃত ত্বক কোষ ঝড়ে পড়ছে ! যারা অংকে ভাল হিসাব করে দেখতে পারেন এ ভাবে প্রতিদিন কি পরিমাণ ত্বক কোষ ঝরে যাচ্ছে । ত্বকের দ্বিতীয় স্তরকে ডারমিস বলে । এটি ঠিক এপিডারমিসের নিচে অবস্থিত । খালি চোখে ত্বকের এই অংশকে দেখা যায় না । রক্তনালী, স্নায়ু প্রান্ত, তেল এবং ঘাম গ্রস্থিসমূহ ত্বকের এই অংশে থাকে । ত্বকের এর পরের অংশকে সাবকিউটেনাস ফ্যাট বলা হয় । নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে ত্বকের এই অংশ মূলত চর্বি দ্বারা গঠিত । ত্বকের এই অংশ দেহকে উষ্ণ রাখার এবং আঘাত সামলানোর কাজ করে ।
এ কথা আমরা সবাই জানি মনে রোগ থাকলে দেহে তার প্রভাব পড়ে । একই ভাবে দেহে রোগ থাকলে মনে তার প্রভাব পড়ে আলোচনার শুরুতেই এ কথা বলেছি । এ বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের প্রধান এসোসিয়েট প্রফেসর শাহাবউদ্দিন চৌধুরির সাথে । মনের উপর ত্বকের প্রভাবের কথা বলতে যেয়ে তিনি প্রথমেই শিশুর কথা টেনে আনেন । তিনি আমাদেরকে জানান একটা শিশু স্পর্শের মাধ্যমে প্রথমেই তার মাকে অনুভব করতে শেখে । এ কারণে দেখা যায় যে সব সন্তান পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে তাদের আত্মবিশ্বাস বেশি থাকে । তিনি শিশুর অনুভুতি সৃষ্টির কথা বলতে যেয়ে জানালেন।
মনোরোগ হলে ত্বকে তার প্রভাব পড়ে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর শাহাবুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আমাদের বললেন, বেশ কিছু রোগ আাছে যার প্রকৃত পক্ষে মনের রোগ কিন্তু তার প্রকাশ ঘটে চামড়ায় । তিনি এ ক্ষেত্রে ডিলিউশ্যন বা হ্যালিসিনেশনের উদাহরণ তুলে ধরেন । ডিলিউশনের ক্ষেত্রে একজন রোগী হয়ত মনে করছেন, তার ত্বকে কৃমি বা পোকা বাসা বেঁধেছে । অথচ প্রকৃতপক্ষে তার ত্বকে এ জাতীয় কিছু নেই । কিন্তু তারপর রোগীর মনের এই কাল্পনিক বিশ্বাস মোটেও হ্রাস পাচ্ছে না । বরং দেহের ত্বকে তিনি প্রতিনিয়ত কৃমি বা পোকা ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতি পাচ্ছেন । এ ছাড়া ফ্যাকটেশিয়াল ডারমাইটিস (Factitial Dermatitis)নামে অপর এক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের ত্বক নিজেই কেটে - ছিঁড়ে ফেলতে পারেন।
অভিজ্ঞ এই চিকিৎসক ত্বকে প্রতিফলিত হয় এ ধরণের আরো কিছু মানসিক রোগের কথা তুলে ধরেন । এ সব রোগীদের কেউ কেউ বসে নিজেই নিজের চুল তুলে ফেলতে পারেন, হাতে কিছু লেগে আছে মনে করে হাত অব্যাহত ভাবে ধৌত করতে পারেন । বার বার ধোয়ার পরও সেই কাল্পনিক জিনিস লেগে থাকার অনুভূতি রোগীর হাত থেকে যায় না। মনোরোগ ত্বকের উপর গভীর প্রভাব ফেলে সে কথা তিনি এভাবেই তুলে ধরেন ।
এর পর তিনি মনের উপর ত্বকের রোগের কথা বলতে যেয়ে প্রথমেই ত্বকের সামাজিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন । তিনি বলেন, সামাজিক ভাবে ত্বকের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে । সুন্দর ত্বকের মানুষ সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন । অন্যদিকে ত্বকের কোনো রোগ দীর্ঘ স্থায়ী হলে তা মানসিক ভাবে প্রভাব ফেলে । তবে এ ক্ষেত্রে রোগীর আত্মবিশ্বাস ও বয়স গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে । অর্থাৎ রোগীর ইতিবাচক আত্মবিশ্বাস বেশি থাকলে চর্ম রোগের ফলে যে সৃষ্ট বিরূপ মানসিক প্রভাব কম হয় । তবে আত্মবিশ্বাসের অভাব বা হীনমন্যতা থাকলে এ প্রভাব বৃদ্ধি পায় । এ ছাড়া রোগী যদি কিশোর বয়সী বা বয়:সন্ধিক্ষণের হয়ে থাকে তবে চর্ম রোগের মানসিক প্রভাব বেশি হতে পারে । এ ধরণের রোগীরা সাধারণ ভাবে হতাশায় ভোগেন বা অসামাজিক হয়ে পড়তে পারেন বলে প্রফেসর শাহাবুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আমাদের বলেছিলেন ।
এ ছাড়া সোরিয়াসিস নামের একটি চর্ম রোগ সাধারণ ভাবে তাদেরই হয় যাদের মনরোগ থাকে, আবার আমবাত নামে পরিচিত একজাতের চর্মরোগ যাদের আছে তাদের মানসিক পীড়ন বা স্ট্রেস বাড়লে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় । মানসিক চাপের কারণে অনেকেরই মাথার চুল পড়ার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মাথায় টাক দেখা দেয় । অর্থাৎ মানসিক চাপ বা সমস্যার কারণে অনেক চর্ম রোগের প্রকোপ এবং স্থায়ীত্ব বেড়ে যায় ।
প্রফেসর শাহাবুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এ ধরণের রোগের চিকিৎসার কথা বলতে যেয়ে আমাদের জানালেন প্রথমেই বললেন, চিকিৎসা করে এসব রোগ সারিয়ে তোলা যায় । এ জাতীয় রোগের ক্ষেত্রে চর্মের যে উপসর্গ দেখা দেয় তা দূর করার জন্য চর্মের ওষুধ দেয়া হয় । এ ছাড়া মনের যে সমস্যা থাকে তা দূর করার জন্য মনোরোগ চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত ওষুধ দেয়া হয় । মনোরোগ জটিল হলে রোগীকে তখন চিকিৎসা করার জন্য মনো-চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া হয় । তবে চর্মের চিকিৎসা করতে এসে রোগী অনেক সময় মনো চিকিৎসকের কাছে যেতে চায় না । সেক্ষেত্রে রোগীকে এর প্রয়াজনীয়তা বোঝাতে হবে । এ ছাড়া মনো চিকিৎসক রোগীর প্রয়োজন বুঝে তাকে আরো চিকিৎসা দিতে পারেন ।

No comments:

Post a Comment