আজকাল সারাক্ষণ মন ভার হয়ে থাকে। ভীষণ একা মনে হয় নিজেকে, মনে হয় কেউ নেই আমার। প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব, সুহূদ-শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ না। মনের ওপর জমে আছে মেঘ, ভোর থেকে শুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। এ সবকিছুর মূলে, আমি বুঝতে পারি, আমার মূল কাজ—যা আমার তুচ্ছ মানব-অস্তিত্বকে অর্থ জুগিয়েছে, সেই লেখালেখিতে আমার সাময়িক যতি। শুধু লেখা কেন, মনোযোগ দিয়ে বইও পড়তে পারছি না কোনো কোনো সময়।
দুঃসহ বিষণ্নতার চাপে আমার একদা স্ফুর্তিময় স্বপ্ন ও কল্পনার একান্ত ভুবনটি এখন বিষণ্ন। এ অভিজ্ঞতা অনেক লেখক-শিল্পীর হয়ে থাকে বলে শুনেছি। তাঁরা মনোভুবনের তমসা থেকে একসময় বেরিয়েও আসেন। আমার আতঙ্ক, যদি আমি বিষণ্নতার এই রুদ্ধগ্রাস থেকে আর বেরিয়ে না আসতে পারি? এসব কাউকে বলা যায় না। সাধারণ গড়পড়তা মানুষ এর গূঢ়ার্থ বুঝবেও না। আসলে ছকবাঁধা দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে এরা ভালো আছে। এটাই জীবনের বিধান। অনাদিকালের মহা সৃষ্টিযজ্ঞে লেখক-শিল্পী-দার্শনিকদের জন্য তৈরি হয়ে গেছে পৃথক এক জগৎ। জগতের ভেতরে শুধু বোধ ও চেতনার আলো-ছায়ায় গড়া আর এক জগৎ। এ জগতেও আছে নিরন্তর বেঁচে থাকার যুদ্ধ। যুদ্ধে যাঁরা পরাজিত হন, তাঁরা বেছে নেন আত্মবিনাশের পথ—আড্ডার বা অভ্যাসের বশে। সেখানে ব্যক্তিগত বেদনা ও নৈরাশ্যের প্রসঙ্গ তুলে পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। তাই অনেকটা স্বগতোক্তির মতো এই লেখা। স্বীকার করতে বাধা নেই, আমার নিজেকে ইদানীং মনে হয় কলিন উইলসনের আউটসাইডার। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘অচেনা’ (প্রমেন্দ্র মিত্র আলবেয়ার কামুর দি আউটসাইডার উপন্যাসটির নামের এই বঙ্গানুবাদ করেছিলেন)। কিছু মানুষ ‘আউটসাইডার’ হয়েই জন্মান। তাঁরা সারা জীবন থেকে যান ‘বহিরাগত’। শিল্প-সাহিত্যের ভুবনে তাঁদের সংখ্যাই বেশি। আবার কারও কারও মধ্যে আউটসাইডারের লক্ষণ থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বাহ্যিক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত চাপে তাঁরা অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন, হয়ে পড়েন জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন—অর্থাৎ ‘অচেনা’। এই দুই দলের কোনটিতে আমি পড়ি, ঠিক বুঝতে পারি না। তবে এটা ঠিক, আমার নৈঃসঙ্গ ও বিষণ্নতা বোধ ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে। একজন লেখকের ‘একা’ হওয়া অবশ্যই জরুরি। তবে সেই একাকিত্ব বাঞ্ছনীয় নয়, যা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে নষ্ট করে ফেলে। এটি একজন লেখক বা শিল্পীকে সমাজে বাসের অযোগ্য করে ফেলে।
তবে এই সর্বনাশা পরিণতি যে আমাদের কারও কারও জন্য ওত পেতে নেই, কে বলতে পারে। আমি সমাজসংশ্লিষ্ট মানুষ। আমারও নিজস্ব ধরনের ‘সোশ্যাল কমিটমেন্ট’ আছে। কিন্তু আমি কোথায় বাস করছি? এই কি সমাজ? যে জনগোষ্ঠীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসংগতি, অনাচার ও হিস্রতা; যেখানে সুচারুভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপনের কোনো নিশ্চয়তাই নেই—তা সমাজের পর্যায়ে পড়ে না। সাহিত্যচর্চা, শিল্পচর্চার জন্য এ এক ভয়ংকর দুঃসময়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে টালমাটাল সময় পার করেছি আমরা। কিন্তু তখনো আমাদের এক হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, অন্য হাতে কলম বা তুলি। তখন আমাদের একটি লক্ষ্য ছিল, ছিল দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের হাতছানি। সাম্প্রতিক কালে আমরা কোনো রকমে টিকে আছি এক বৈরী সময়ে। লক্ষ্যহীন। স্বপ্নহীন। রাষ্ট্র ও সমাজের মূল কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে চাইছে অশুভ কিছু শক্তি।
এসবের মধ্যেও সাহিত্যচর্চা হয়। তরুণ এবং সিনিয়র কবি ও গল্পকারেরা কাজ করে যান। সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগ, দৈনিক কাগজের সাপ্তাহিক সাহিত্য সাময়িকী বেরোয়। বলতে সংকোচ নেই, এ সবই আমার কাছে মনে হয় এক ধরনের প্যান্টোমাইম বা মূকাভিনয়। নিঃসাড় মানুষের মতো আমরা শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য যে যার ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছি। আমিও এর বাইরে নই। কবিতা, গল্প বা উপন্যাসের একটা ছাঁদ দাঁড়িয়ে গেছে অনেক দিন। টেবিলে বসলেই ছাঁচে-ফেলা কবিতা লেখা যায়। কিন্তু এটা আত্মপ্রতারণা। অনেক সময় নিজের কবিতা পড়ে নিজেই বিব্রত হই। না, হচ্ছে না। অন্যদের কবিতা পড়ি। ওখানেও চমকে দেওয়ার মতো দ্যুতি বা ঝলকের অভাব। রাশি রাশি সৃজনশীল বই বের হচ্ছে গ্রন্থমেলায়। হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখি। খুব কম বইয়ে মন বসাতে পারি। সম্প্রতি আরেক অনাচার শুরু হয়েছে কবিতা-ভাষা নিয়ে, নিরীক্ষার নামে। আমরা ভুলে যাই, যত ভাঙচুরই করি না কেন, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও কবিতার একটি ধ্রুপদ এবং প্রমিত রূপ আছে। আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতা থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে যাঁরা কবিতাচর্চা করতে চান, তাঁদের কবিতাপ্রেম নিয়ে সন্দেহ জাগতে পারে পাঠকের।
বাংলাদেশের সাহিত্যে মন্দার কাল চলছে। আমি দিন পার করছি এক বিভীষিকার ভেতর দিয়ে, যার উৎস বিষাদ এবং একাকিত্বে। মনের মতো করে লিখতে পারছি না। তাই বইয়ে ডুবে থাকার চেষ্টা করছি। টেবিলে না-পড়া বইয়ের স্তূপ। বইয়ের নেশা আছে বলেই হয়তো টিকে যাব এ যাত্রা। সংগীতও আমাদের বাঁচায় বিভিন্ন সংকটে।
দুঃসহ বিষণ্নতার চাপে আমার একদা স্ফুর্তিময় স্বপ্ন ও কল্পনার একান্ত ভুবনটি এখন বিষণ্ন। এ অভিজ্ঞতা অনেক লেখক-শিল্পীর হয়ে থাকে বলে শুনেছি। তাঁরা মনোভুবনের তমসা থেকে একসময় বেরিয়েও আসেন। আমার আতঙ্ক, যদি আমি বিষণ্নতার এই রুদ্ধগ্রাস থেকে আর বেরিয়ে না আসতে পারি? এসব কাউকে বলা যায় না। সাধারণ গড়পড়তা মানুষ এর গূঢ়ার্থ বুঝবেও না। আসলে ছকবাঁধা দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে এরা ভালো আছে। এটাই জীবনের বিধান। অনাদিকালের মহা সৃষ্টিযজ্ঞে লেখক-শিল্পী-দার্শনিকদের জন্য তৈরি হয়ে গেছে পৃথক এক জগৎ। জগতের ভেতরে শুধু বোধ ও চেতনার আলো-ছায়ায় গড়া আর এক জগৎ। এ জগতেও আছে নিরন্তর বেঁচে থাকার যুদ্ধ। যুদ্ধে যাঁরা পরাজিত হন, তাঁরা বেছে নেন আত্মবিনাশের পথ—আড্ডার বা অভ্যাসের বশে। সেখানে ব্যক্তিগত বেদনা ও নৈরাশ্যের প্রসঙ্গ তুলে পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। তাই অনেকটা স্বগতোক্তির মতো এই লেখা। স্বীকার করতে বাধা নেই, আমার নিজেকে ইদানীং মনে হয় কলিন উইলসনের আউটসাইডার। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘অচেনা’ (প্রমেন্দ্র মিত্র আলবেয়ার কামুর দি আউটসাইডার উপন্যাসটির নামের এই বঙ্গানুবাদ করেছিলেন)। কিছু মানুষ ‘আউটসাইডার’ হয়েই জন্মান। তাঁরা সারা জীবন থেকে যান ‘বহিরাগত’। শিল্প-সাহিত্যের ভুবনে তাঁদের সংখ্যাই বেশি। আবার কারও কারও মধ্যে আউটসাইডারের লক্ষণ থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বাহ্যিক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত চাপে তাঁরা অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন, হয়ে পড়েন জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন—অর্থাৎ ‘অচেনা’। এই দুই দলের কোনটিতে আমি পড়ি, ঠিক বুঝতে পারি না। তবে এটা ঠিক, আমার নৈঃসঙ্গ ও বিষণ্নতা বোধ ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে। একজন লেখকের ‘একা’ হওয়া অবশ্যই জরুরি। তবে সেই একাকিত্ব বাঞ্ছনীয় নয়, যা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে নষ্ট করে ফেলে। এটি একজন লেখক বা শিল্পীকে সমাজে বাসের অযোগ্য করে ফেলে।
তবে এই সর্বনাশা পরিণতি যে আমাদের কারও কারও জন্য ওত পেতে নেই, কে বলতে পারে। আমি সমাজসংশ্লিষ্ট মানুষ। আমারও নিজস্ব ধরনের ‘সোশ্যাল কমিটমেন্ট’ আছে। কিন্তু আমি কোথায় বাস করছি? এই কি সমাজ? যে জনগোষ্ঠীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসংগতি, অনাচার ও হিস্রতা; যেখানে সুচারুভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপনের কোনো নিশ্চয়তাই নেই—তা সমাজের পর্যায়ে পড়ে না। সাহিত্যচর্চা, শিল্পচর্চার জন্য এ এক ভয়ংকর দুঃসময়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে টালমাটাল সময় পার করেছি আমরা। কিন্তু তখনো আমাদের এক হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, অন্য হাতে কলম বা তুলি। তখন আমাদের একটি লক্ষ্য ছিল, ছিল দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের হাতছানি। সাম্প্রতিক কালে আমরা কোনো রকমে টিকে আছি এক বৈরী সময়ে। লক্ষ্যহীন। স্বপ্নহীন। রাষ্ট্র ও সমাজের মূল কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে চাইছে অশুভ কিছু শক্তি।
এসবের মধ্যেও সাহিত্যচর্চা হয়। তরুণ এবং সিনিয়র কবি ও গল্পকারেরা কাজ করে যান। সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগ, দৈনিক কাগজের সাপ্তাহিক সাহিত্য সাময়িকী বেরোয়। বলতে সংকোচ নেই, এ সবই আমার কাছে মনে হয় এক ধরনের প্যান্টোমাইম বা মূকাভিনয়। নিঃসাড় মানুষের মতো আমরা শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য যে যার ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছি। আমিও এর বাইরে নই। কবিতা, গল্প বা উপন্যাসের একটা ছাঁদ দাঁড়িয়ে গেছে অনেক দিন। টেবিলে বসলেই ছাঁচে-ফেলা কবিতা লেখা যায়। কিন্তু এটা আত্মপ্রতারণা। অনেক সময় নিজের কবিতা পড়ে নিজেই বিব্রত হই। না, হচ্ছে না। অন্যদের কবিতা পড়ি। ওখানেও চমকে দেওয়ার মতো দ্যুতি বা ঝলকের অভাব। রাশি রাশি সৃজনশীল বই বের হচ্ছে গ্রন্থমেলায়। হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখি। খুব কম বইয়ে মন বসাতে পারি। সম্প্রতি আরেক অনাচার শুরু হয়েছে কবিতা-ভাষা নিয়ে, নিরীক্ষার নামে। আমরা ভুলে যাই, যত ভাঙচুরই করি না কেন, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও কবিতার একটি ধ্রুপদ এবং প্রমিত রূপ আছে। আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতা থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে যাঁরা কবিতাচর্চা করতে চান, তাঁদের কবিতাপ্রেম নিয়ে সন্দেহ জাগতে পারে পাঠকের।
বাংলাদেশের সাহিত্যে মন্দার কাল চলছে। আমি দিন পার করছি এক বিভীষিকার ভেতর দিয়ে, যার উৎস বিষাদ এবং একাকিত্বে। মনের মতো করে লিখতে পারছি না। তাই বইয়ে ডুবে থাকার চেষ্টা করছি। টেবিলে না-পড়া বইয়ের স্তূপ। বইয়ের নেশা আছে বলেই হয়তো টিকে যাব এ যাত্রা। সংগীতও আমাদের বাঁচায় বিভিন্ন সংকটে।
No comments:
Post a Comment