সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্ অগ্রন্থিত রচনা
গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা, স্মৃতিকথা ও চিঠি
প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চীেধুরী
দাম: ১৬০ টাকা
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলাদেশের সাহিত্যের সবচেয়ে মর্যাদাবান শিল্পীদের একজন। কিন্তু যতটা মর্যাদা তিনি পেয়েছেন, তাঁকে নিয়ে গবেষণা আর তাঁর রচনাবলির বিশ্লেষণধর্মী পাঠ সে অনুপাতে হয়েছে বলে মনে হয় না। তাঁর দুটি ইংরেজি রচনা—দ্য আগলি এশিয়ান ও হাউ ডাজ ওয়ান কুক বিনস—অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হতে যে এত বছর লেগে গেল, তা জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের শৈথিল্যেরই প্রমাণ। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত অগ্রন্থিত রচনা আরেকবার প্রমাণ করল, এ দেশে ওয়ালীউল্লাহ্চর্চা চলছে যথেষ্ট ঢিমেতালে। আশার কথা এই, পূর্বোক্ত দুটি ইংরেজি গ্রন্থের অনুবাদ এবং বর্তমান অগ্রন্থিত রচনা কোনো অ্যাকাডেমিক গবেষণার ফলস্বরূপ বেরিয়ে আসেনি। তাতে বোঝা যায়, লেখক হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্ অদ্যাবধি পাঠকসমাজে ভালোভাবেই বেঁচে আছেন—নিছক গবেষণার উপাদান হয়ে ওঠেননি। ‘প্রথমা’র আয়োজনে প্রকাশিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র অগ্রন্থিত রচনা সম্পাদনা করেছেন কবি-প্রাবন্ধিক সাজ্জাদ শরিফ। এ সংকলনে আছে একটি অনূদিত গল্প ‘মুক্তি’, একটি অসম্পূর্ণ গল্প ‘আমাদের প্রপিতামহ’, চিত্রকলাসম্পর্কিত দুটি সমালোচনামূলক নিবন্ধ, মূল্যায়নধর্মী স্মৃতিকথানির্ভর গদ্য ‘বাহারদা’, আর হূষীকেশ লাহিড়ীকে লেখা ২০টি চিঠি। ছোট্ট এ সংকলনটি আদ্যোপান্ত পড়ে একে ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্মের এক জরুরি অংশ বলেই মনে হলো। মনে হওয়ার অন্যতম কারণ অনূদিত গল্প মুক্তি। সেকালের অন্য অনেকের মতো ওয়ালীউল্লাহ্ও দেশ ভাগের অনিবার্যতা স্বীকার করতেন। এ সংকলনের চিঠিপত্রে—এবং অন্য রচনায়ও—এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের বক্তব্য পাওয়া যায়। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট দেশ ভাগের সঙ্গী হয়ে মনুষ্যসৃষ্ট যেসব বিপর্যয় বিপুল মানুষের সঙ্গী হয়েছিল, তা গভীরভাবে উপলব্ধি করার মতো সংবেদনশীলতাও তাঁর ছিল। বাংলাদেশের অসংখ্য লেখকের মতো পক্ষ-বিপক্ষের ফর্দ তৈরির মধ্যেই ব্যাপারটাকে তিনি হারিয়ে ফেলেননি। মুক্তি গল্পে পাওয়া গেছে ওই বিপর্যস্ত সময়ের গা-ছমছমে ভাষ্য। বাস্তবতার বীভৎসতায় বেকুব বনে যাওয়া এক তরুণের ভাঙা ভাঙা গল্পে স্ফুট-অস্ফুট কিছু ইমেজ আর কিছু টুকরা কাহিনিকে ট্রেনের এক কামরায় ওয়ালীউল্লাহ্ ভাঁজমতো আঁটিয়ে ফেলেছেন, যেখানে একদিকে আমাদের চেনা লেখকটি পুরোপুরি হাজির, অন্যদিকে আবার আনকোরা ‘হয়ে যাওয়া’ টাটকা গল্পের স্বাদও লভ্য। উপলব্ধির গাঢ়তা, বাস্তবতার আধা-বিমূর্ত তীব্রতা আর ধীরস্থির বয়ানে বহুস্তর ইফেক্ট তৈরির মুনশিয়ানায় মুক্তি ওয়ালীউল্লাহ্র সেরা গল্পের তালিকায় পড়বে। জয়নুল আবেদিন-সম্পর্কিত প্রবন্ধটি অন্তত তিনটি কারণে অতি মূল্যবান। প্রথমত, জয়নুলের সক্ষমতা ও অর্জনের একটি পরিচ্ছন্ন হিসাব এখানে আছে। দ্বিতীয়ত, রচনাটি চিত্রকলা-সমালোচনার ভঙ্গি ও ভাষার উচ্চাঙ্গের নিদর্শন। তৃতীয়ত, আধুনিক শিল্পকলা সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহ্র দৃষ্টিভঙ্গি এ লেখায় স্পষ্ট হয়েছে, যা তাঁর নিজের সাহিত্যকর্মের জন্যও প্রযোজ্য। একটি উদাহরণ দিই। ওয়ালীউল্লাহ্ লিখেছেন: ‘শিল্পের দায়িত্ব হলো এমন এক প্রাণবন্ত ও নান্দনিক রীতি তৈরি করা, যা সাংস্কৃতিকভাবে অক্রিয় জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রণালিতে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখে। আমরা আমদানি করা হাড়গোড়ে প্রাণসঞ্চার প্রত্যাশা করতে পারি না।’ এ ধরনের আরও বহু বাক্য আছে চিত্রকলাসম্পর্কিত রচনাগুলোয়, যা ‘আধুনিক’ শিল্পী হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্র আত্মার খবর দেয়। ওয়ালীউল্লাহ্ জীবনচেতনা ও শিল্পরীতিতে পশ্চিমা অর্থেই ‘আধুনিক’, এবং সে অর্থেই দায়িত্বশীল। অনুকারী ‘আধুনিকতা’র দায়দায়িত্বহীন তত্ত্ব ও চর্চার যে ধারা বাংলা সাহিত্যজগতে খুব প্রতাপশালী, এ অবস্থান তা থেকে অনেক আলাদা। এ সংকলনের ২০টি চিঠি আমাদের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ ওয়ালীউল্লাহ্র পরিচয় করিয়ে দেয়। বিশেষভাবে যৌবনের ওয়ালীউল্লাহ্র, যিনি দেশ ভাগ, সাম্প্রদায়িক সমস্যা আর রাজনীতির জটিল সময়ে সচেতন জীবন কাটিয়েছেন। এগুলো অনেকাংশে বাংলার ইতিহাসের অমীমাংসিত অধ্যায়; আর সে কারণেই ওয়ালীউল্লাহ্র সাক্ষ্যের বিশেষ মূল্য আছে। হবীবুল্লাহ্ বাহারকে নিয়ে লেখা গদ্যটিও এদিক থেকে মূল্যবান। মুক্তি গল্পটি অনুবাদ করেছেন শহীদুল জহির; প্রবন্ধ কটির অনুবাদক শিবব্রত বর্মন। দুজনই নিজ নিজ নামের মর্যাদা রেখেছেন। মূল না পড়ে অনুবাদের যতটা প্রশংসা করা যায়, অনুবাদগুলো তার চেয়েও ভালো হয়েছে। তবু মূল ইংরেজি রচনাগুলো সংকলিত হওয়া আবশ্যিক ছিল। এ কথা তো বলতেই হবে, অনুবাদ নয়, মূল রচনাগুলোই ওয়ালীউল্লাহ্র রচনা। বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধটির কথা। নিবন্ধটি সুলিখিত-সুখপাঠ্য ও কাজের। এতে ওয়ালীউল্লাহ্-সম্পর্কিত বিগত এবং সম্ভাব্য গবেষণার পরিচ্ছন্ন রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। ওয়ালীউল্লাহ্-পাঠের বিদ্যমান ধারা সম্পর্কে সংগত কিছু প্রশ্ন তুলেছেন সম্পাদক, পাশাপাশি দিয়েছেন নতুন পাঠের নির্দেশনা। অগ্রন্থিত রচনার সম্পাদনায়-প্রকাশনায়-অনুবাদে ওয়ালীউল্লাহ্র মর্যাদা রক্ষিত হয়েছে।
গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা, স্মৃতিকথা ও চিঠি
প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চীেধুরী
দাম: ১৬০ টাকা
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলাদেশের সাহিত্যের সবচেয়ে মর্যাদাবান শিল্পীদের একজন। কিন্তু যতটা মর্যাদা তিনি পেয়েছেন, তাঁকে নিয়ে গবেষণা আর তাঁর রচনাবলির বিশ্লেষণধর্মী পাঠ সে অনুপাতে হয়েছে বলে মনে হয় না। তাঁর দুটি ইংরেজি রচনা—দ্য আগলি এশিয়ান ও হাউ ডাজ ওয়ান কুক বিনস—অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হতে যে এত বছর লেগে গেল, তা জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের শৈথিল্যেরই প্রমাণ। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত অগ্রন্থিত রচনা আরেকবার প্রমাণ করল, এ দেশে ওয়ালীউল্লাহ্চর্চা চলছে যথেষ্ট ঢিমেতালে। আশার কথা এই, পূর্বোক্ত দুটি ইংরেজি গ্রন্থের অনুবাদ এবং বর্তমান অগ্রন্থিত রচনা কোনো অ্যাকাডেমিক গবেষণার ফলস্বরূপ বেরিয়ে আসেনি। তাতে বোঝা যায়, লেখক হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্ অদ্যাবধি পাঠকসমাজে ভালোভাবেই বেঁচে আছেন—নিছক গবেষণার উপাদান হয়ে ওঠেননি। ‘প্রথমা’র আয়োজনে প্রকাশিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র অগ্রন্থিত রচনা সম্পাদনা করেছেন কবি-প্রাবন্ধিক সাজ্জাদ শরিফ। এ সংকলনে আছে একটি অনূদিত গল্প ‘মুক্তি’, একটি অসম্পূর্ণ গল্প ‘আমাদের প্রপিতামহ’, চিত্রকলাসম্পর্কিত দুটি সমালোচনামূলক নিবন্ধ, মূল্যায়নধর্মী স্মৃতিকথানির্ভর গদ্য ‘বাহারদা’, আর হূষীকেশ লাহিড়ীকে লেখা ২০টি চিঠি। ছোট্ট এ সংকলনটি আদ্যোপান্ত পড়ে একে ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্মের এক জরুরি অংশ বলেই মনে হলো। মনে হওয়ার অন্যতম কারণ অনূদিত গল্প মুক্তি। সেকালের অন্য অনেকের মতো ওয়ালীউল্লাহ্ও দেশ ভাগের অনিবার্যতা স্বীকার করতেন। এ সংকলনের চিঠিপত্রে—এবং অন্য রচনায়ও—এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের বক্তব্য পাওয়া যায়। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট দেশ ভাগের সঙ্গী হয়ে মনুষ্যসৃষ্ট যেসব বিপর্যয় বিপুল মানুষের সঙ্গী হয়েছিল, তা গভীরভাবে উপলব্ধি করার মতো সংবেদনশীলতাও তাঁর ছিল। বাংলাদেশের অসংখ্য লেখকের মতো পক্ষ-বিপক্ষের ফর্দ তৈরির মধ্যেই ব্যাপারটাকে তিনি হারিয়ে ফেলেননি। মুক্তি গল্পে পাওয়া গেছে ওই বিপর্যস্ত সময়ের গা-ছমছমে ভাষ্য। বাস্তবতার বীভৎসতায় বেকুব বনে যাওয়া এক তরুণের ভাঙা ভাঙা গল্পে স্ফুট-অস্ফুট কিছু ইমেজ আর কিছু টুকরা কাহিনিকে ট্রেনের এক কামরায় ওয়ালীউল্লাহ্ ভাঁজমতো আঁটিয়ে ফেলেছেন, যেখানে একদিকে আমাদের চেনা লেখকটি পুরোপুরি হাজির, অন্যদিকে আবার আনকোরা ‘হয়ে যাওয়া’ টাটকা গল্পের স্বাদও লভ্য। উপলব্ধির গাঢ়তা, বাস্তবতার আধা-বিমূর্ত তীব্রতা আর ধীরস্থির বয়ানে বহুস্তর ইফেক্ট তৈরির মুনশিয়ানায় মুক্তি ওয়ালীউল্লাহ্র সেরা গল্পের তালিকায় পড়বে। জয়নুল আবেদিন-সম্পর্কিত প্রবন্ধটি অন্তত তিনটি কারণে অতি মূল্যবান। প্রথমত, জয়নুলের সক্ষমতা ও অর্জনের একটি পরিচ্ছন্ন হিসাব এখানে আছে। দ্বিতীয়ত, রচনাটি চিত্রকলা-সমালোচনার ভঙ্গি ও ভাষার উচ্চাঙ্গের নিদর্শন। তৃতীয়ত, আধুনিক শিল্পকলা সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহ্র দৃষ্টিভঙ্গি এ লেখায় স্পষ্ট হয়েছে, যা তাঁর নিজের সাহিত্যকর্মের জন্যও প্রযোজ্য। একটি উদাহরণ দিই। ওয়ালীউল্লাহ্ লিখেছেন: ‘শিল্পের দায়িত্ব হলো এমন এক প্রাণবন্ত ও নান্দনিক রীতি তৈরি করা, যা সাংস্কৃতিকভাবে অক্রিয় জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রণালিতে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখে। আমরা আমদানি করা হাড়গোড়ে প্রাণসঞ্চার প্রত্যাশা করতে পারি না।’ এ ধরনের আরও বহু বাক্য আছে চিত্রকলাসম্পর্কিত রচনাগুলোয়, যা ‘আধুনিক’ শিল্পী হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্র আত্মার খবর দেয়। ওয়ালীউল্লাহ্ জীবনচেতনা ও শিল্পরীতিতে পশ্চিমা অর্থেই ‘আধুনিক’, এবং সে অর্থেই দায়িত্বশীল। অনুকারী ‘আধুনিকতা’র দায়দায়িত্বহীন তত্ত্ব ও চর্চার যে ধারা বাংলা সাহিত্যজগতে খুব প্রতাপশালী, এ অবস্থান তা থেকে অনেক আলাদা। এ সংকলনের ২০টি চিঠি আমাদের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ ওয়ালীউল্লাহ্র পরিচয় করিয়ে দেয়। বিশেষভাবে যৌবনের ওয়ালীউল্লাহ্র, যিনি দেশ ভাগ, সাম্প্রদায়িক সমস্যা আর রাজনীতির জটিল সময়ে সচেতন জীবন কাটিয়েছেন। এগুলো অনেকাংশে বাংলার ইতিহাসের অমীমাংসিত অধ্যায়; আর সে কারণেই ওয়ালীউল্লাহ্র সাক্ষ্যের বিশেষ মূল্য আছে। হবীবুল্লাহ্ বাহারকে নিয়ে লেখা গদ্যটিও এদিক থেকে মূল্যবান। মুক্তি গল্পটি অনুবাদ করেছেন শহীদুল জহির; প্রবন্ধ কটির অনুবাদক শিবব্রত বর্মন। দুজনই নিজ নিজ নামের মর্যাদা রেখেছেন। মূল না পড়ে অনুবাদের যতটা প্রশংসা করা যায়, অনুবাদগুলো তার চেয়েও ভালো হয়েছে। তবু মূল ইংরেজি রচনাগুলো সংকলিত হওয়া আবশ্যিক ছিল। এ কথা তো বলতেই হবে, অনুবাদ নয়, মূল রচনাগুলোই ওয়ালীউল্লাহ্র রচনা। বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধটির কথা। নিবন্ধটি সুলিখিত-সুখপাঠ্য ও কাজের। এতে ওয়ালীউল্লাহ্-সম্পর্কিত বিগত এবং সম্ভাব্য গবেষণার পরিচ্ছন্ন রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। ওয়ালীউল্লাহ্-পাঠের বিদ্যমান ধারা সম্পর্কে সংগত কিছু প্রশ্ন তুলেছেন সম্পাদক, পাশাপাশি দিয়েছেন নতুন পাঠের নির্দেশনা। অগ্রন্থিত রচনার সম্পাদনায়-প্রকাশনায়-অনুবাদে ওয়ালীউল্লাহ্র মর্যাদা রক্ষিত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment