বাবা তার নাম রেখেছিলেন বকুল, কেন রেখেছিলেন বাবাই জানেন। তবে ইদানীং ওর প্রায়ই মনে হয়, এই খানিক পচা গন্ধযুক্ত নামটি বাবা না-ও রাখতে পারতেন। বিশেষত, বৈশাখ মাসে যখন বকুল ফোটে এবং বকুল যখন তার বাড়ির সামনের গাছের তলা দিয়ে সকালে হেঁটে যায়, ওর অসহ্য লাগে। সকালের সেই গন্ধটা সারা দিন যায় না নাক থেকে এবং শোয়ার আগে বিছানায় গেলে গন্ধটা আরও তীব্র হয়। তখন পলি সারা দিন পরিশ্রম করে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। বকুলের ঘুম আসে না। প্রথমত, সে মনে করে তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, সে জানালা খুলে দেয়। দক্ষিণ দিক থেকে হু হু করে গরম বাতাস চলে আসে ঘরে। কিছুটা স্বস্তি পায়, তবে খুব কাজ হয় না। দ্বিতীয়ত, তার মনে হয়, কোথায় যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। যদিও বিষয়টি হচ্ছে বেশ কিছুদিন থেকে, তবু সে বুঝতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সে ঘুমানোর পুরোনো একটি পদ্ধতি কাজে লাগাতে শুরু করে। বুকডন দেওয়া ডাক্তার নিষেধ করেছেন বলে শুধু উঠবস করে পনেরোবার, বাথরুমে যায়, ঘাড়ে ভেজা গামছা দিয়ে ১০ মিনিট ম্যাসাজ করে। ফিরে আসে বিছানায়। পলির নাকডাকা এখন কিছুটা কম। মনে মনে ভাবে, এখনই ঘুমিয়ে পড়ার সর্বোত্তম সময়। ডান কাতে শুয়ে আবার চেষ্টা করে অনেকক্ষণ। তবু ঘুম আসে না।
সে কখনো ইনসমনিয়ার রোগী ছিল না। গত পঞ্চাশ বছরে এ রকম যে দু-একবার হয়নি, তা নয়। তবে সপ্তাহ খানেক ধরে, বিশেষ করে আজকেরটা তার ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। সে মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। বারান্দায় গিয়ে বসে ইজি চেয়ারটায়। সামনে ছোট একটা জঙ্গলের মতো, তার ওপাশে একটা বড় বিল্ডিং। তার মাথা ছুঁয়ে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ দেখা যাচ্ছে। এখনই হয়তো সে মেঘের আড়ালে যাবে। এখন কি শুক্লপক্ষ? না, তা হবে কেন? কৃষ্ণপক্ষই হবে। কী মনে করে বকুল ছেলেমেয়েদের ঘরের দিকে যায়। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস। রাতে ঘুম ভাঙলে একবার ওদের দেখে আসে। এখন যদিও ওরা বড় হয়েছে। দুই ঘরে দুজন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা একদম বাবার মতো দেখতে হয়েছে। পলি এ নিয়ে প্রায়ই খোঁটা দেয়। ‘বাবার মতো মানে ঢিলেঢালা, অগোছালো, জীবনে কিছুই ভালোভাবে করতে পারবে না। সিম্পলি ক্যালাস।’ বকুল রাগ করে না। কারণ, তার মতো হলেও তো অনেক। তবে মেয়ে তার চেয়ে ভালো হয়েছে। সে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্টে পড়ছে। ছেলেটা এইচএসসি পাস করল। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। ও বুয়েটে পড়তে চায়। দেখা যাক। ছেলের ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার তাকায়। আবার ফিরে আসে বারান্দায়।
একটা গানের কলি মনের মধ্যে ভেসে আসে। মিথিলার সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয় এক গানের আসরে, তখন বকুল কলেজে পড়ত। আর মিথিলা পড়ত ক্লাস নাইনে। ছোট্ট মফস্বল শহরে সবাই সবাইকে চিনত। ওই দিন মিথিলা স্কুলের মাঠে গান গাওয়ার পরে যেন ওকে নতুন করে আবিষ্কার করে বকুল। রবিঠাকুরের একটি গান। গানের পরে ও যখন মিথিলাকে বলে, ‘তোমার গান খুব সুন্দর।’ মিথিলা বলেছিল, ‘মানে কী?’ কিছুটা হকচকিত হয়ে বকুল বলে, ‘মানে, অসম্ভব সুন্দর করে তুমি গানটি গাইলে।’ ‘তাই নাকি? নাকি অন্য কিছু, আমি তো জানি, আমি এই গানটি গাইতেই পারি না। তুমি শুধু শুধু আমাকে প্রশংসা করছ। মতলব কী?’ কোনো কথা বলতে পারছিল না বকুল। তোতলাতে তোতলাতে বলেছিল, ‘না না, আমি তো গানটি জানি, তু-তুমি ভালোই গেয়েছ।’ একটা লাল আভা ওর মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল আর মিথিলা সেটা লক্ষও করেছিল। মিথিলা ওর চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে তখন বলে, ‘আচ্ছা, তুমি তো গান করো, গান লেখোও। তো বলো তো, কিছু পলাশের নেশা আর কিছুটা চাঁপায় মেশা—এর মানে কী? মানে জানলে নাকি এক্সপ্রেশনটা ভালো হয়। আমার ওস্তাদ আমাকে বলেছে।’ এবার আরও বিপদে পড়ে বকুল। সে বলে, ‘এটা তো রবীন্দ্রনাথের গান, আমি ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তবে পলাশ আর চাঁপার প্রকাশিত আনন্দকে প্রেমের অভিব্যক্তির সঙ্গে মিশিয়েছেন কবি।’ মিথিলা বলে, ‘বাহ্! বেশ, ভালো ব্যাখ্যা তো! আর একটু গুছিয়ে বলবে?’ ততক্ষণে বকুল বুঝতে পারে দুটো জিনিস। তাকে নিয়ে মিথিলা মজা করছে। ওর বয়সের চেয়ে ছোট একটা মেয়ে ওকে নিয়ে কেমন খেলছে। সে এ-ও বোঝে যে সে মিথিলার প্রগাঢ় চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। সে তোতলাচ্ছে আর কেমন শিহরিত হচ্ছে। কিছুটা বিব্রত, তবে ভালোও লাগছে। এই অবস্থার নাম যা-ই হোক, আগে সে কখনো এ অবস্থায় পড়েনি। সেদিন সে আর কোনো কথা বাড়ায়নি।
তারপর তাদের অনেক কথা হয়েছে। মিথিলার সঙ্গে স্বাভাবিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়েছে। পড়াশোনা, গান, আবৃত্তি নিয়ে কথা হয়েছে। কেউ কোনো দিন এ নিয়ে কথা বলেনি। কারণ, বাহ্যত তারা গোপন কিছু করেনি। বকুলের বাবা কলেজের অধ্যাপক আর মিথিলার বাবা ছিলেন চিকিৎসক। শিক্ষিত পরিবার বলে তাদের নিয়ে কেউ কোনো কথা বলত না। পাড়ার লোকজনও তেমন কিছু বলত না। বকুল কলেজ পাস করে ঢাকায় চলে গেলে দৃশ্যত তাদের সঙ্গে আর আগের মতো তেমন দেখা হতো না। কোনো বিশেষ উৎসবে বাড়ি এলে দেখা হতো কখনো কখনো। হার্দিক সম্পর্ক ছিল, তবে খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না। তারপর তো বকুল লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নিল, বিয়ে করল পলিকে। ওর খালাতো বোন। সে-ও লেখাপড়ায় বকুলের সমসাময়িক, তবে সে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ছেলেমেয়েদের ঝামেলার জন্য কোনো চাকরি সে করেনি। সংসারের জন্য তার বিশাল টান, বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বকুলকে নিয়ে সে কখনো ভেবেছে বলে তার মনে হয় না। মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটে। বাবা-মা বিয়ে দিয়েছিল, বকুল না করেনি। পলিও আপত্তি করেনি। করলে হয়তো বিয়েটা হতো না। কারণ, পলি সব দিক দিয়ে উপযুক্ত পাত্রী ছিল। যেমন লেখাপড়া, তেমনি ছিল ওর চেহারা। তুলনায় বকুল একটু পিছিয়ে ছিল। চাকরি সে ভালোই পেয়েছিল, তবে রংটা তার উজ্জ্বল ছিল না। পলিকে বিয়ের পর একবার সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিল বকুল, ‘আচ্ছা, আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছিল কেন?’ প্রশ্নটা বোকার মতো। তবু সে করেছিল। উত্তরে পলি বলেছিল, ‘তোমাকে পছন্দ করেছিলাম কে বলল? মোটেও পছন্দ করিনি, তোমার মতো হাদারামকে কে পছন্দ করবে শুনি?’ ‘তাহলে আমি কি ভুল শুনেছিলাম?’ প্রশ্ন করে বকুল পলির দিকে তাকাতেই দেখে সে মিটিমিটি হাসছে। এই বিষয়টা বকুল কখনো বোঝে না। তবে তাকে নিয়ে পলি সব সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এটা ঠিক, আবার যত্নআত্তি তো কম করে না। বিয়ের বিশ বছর পার হলেও মারাত্মক কোনো অঘটন ঘটেনি তাদের মধ্যে। সে হিসেবে সে ভালোই আছে বলতে হবে।
তবে আজ কেন এমন হচ্ছে? বকুলের কেন পলাশের নেশায় টানছে? এ কি স্রেফ নিদ্রাহীনতার কারণে? মিথিলা কেন বারবার ফিরে ফিরে আসছে? সেই চোখ, সেই ভ্রুকুঞ্চন, সেই মৃদু হাসি। সেই বোকা বানানোর মতলব চোখে-মুখে। সে ক্রমশ এটা ভাবতে থাকে যে অন্তত একবার হলেও সে মিথিলার সঙ্গে দেখা করবে। সে জানে কোথায় থাকে সে। প্রয়োজন হয়নি বলে কখনো যায়নি। এখন যেন গলা শুকিয়ে আসছে, বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে। প্রথম পরিচয়ের সময় এ রকম হতো। মাঝে পঁচিশ বছরের মতো ব্যবধান। কী বলবে সে? শুধু দেখা করবে? তার স্বামী কী বলবে? মিথিলা কী বলবে? ভীমরতি? সে হয়তো কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবে না।
সকালে অফিসে গিয়ে কয়েকজনের কাছে ফোন করে সে মিথিলার নম্বর পেল। সারা রাত না ঘুমানোর ক্লান্তি চোখে। একবার মনে হলো আজই যাবে। পরক্ষণে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করল। বাসায় ফিরে বিকেলে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল। ঘুম আসে না। পলিকে বলা যায় কি না, ভাবল। সাহস হলো না। এত দিনে তার প্রবলভাবে মনে হচ্ছে যে সে মিথিলাকে ভালোবাসত। আগেও বহুবার মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, একবার অন্তত কথাটা মিথিলাকে বলা দরকার। পরে মনে হয়েছে, বেচারাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? আগে যখন বলিনি, এখন বলে যন্ত্রণা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কিন্তু মিথিলা সব সময় ভাসছে চোখের সামনে। কাজে ভুল হচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেছে সামলে নিতে, নিজেকে বোঝাতে পারেনি।
পাঁচ দিনের মাথায় একদিন সে পার্কে দেখা করার সুযোগ পেল মিথিলার সঙ্গে। মিথিলা খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। সে বলল, ‘কী ব্যাপার? তুমি এত দিন পরে কী বলতে চাও? পুরোনো প্রেম কি জাগ্রত হলো?’ মিথিলা বেগুনি রঙের একটি শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউজ। এই প্রথম বকুল তাকে শাড়ি পরতে দেখল। বকুল কিছু বলতে পারে না। শুধু বলে, ‘না, কোনো ব্যাপার না। তোমার সঙ্গে কতকাল দেখা হয় না।’ মিথিলা বলে, ‘তুমি কি সংসারজীবনে অসুখী হয়েছ?’ ‘না, নাতো!’ গলাটা হালকা কেঁপে যায় বকুলের। বকুলের মনে হয়, সে প্রথম দিনের মতো দেখছে মিথিলাকে সেই অবগাহনের আনন্দে। সে বেশ সাহস করে তাকায় ওর দিকে। মিথিলা পুরোনো স্বভাবে বলে, ‘বেশ তো, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছ। ভালো সাহস হয়েছে তো দেখছি। কোত্থেকে পেলে সাহস? আসার সময় বউয়ের অনুমতি নিয়ে এসেছ?’ বকুল চুপসে যায়। বলে, ‘তুমি আগের মতোই আছ। আমি ভেবেছিলাম, তুমি বদলে গেছ।’ ‘বদলাব কেন? কার জন্য বদলাব, কার নির্দেশে বদলাব?’ মিথিলা বলে।
বড় অর্জুনগাছের ওপর দিয়ে বিকেলের ম্লান সূর্য ওদের দুজনের মুখে খানিকটা আলো দেয়, খানিকটা প্রাণিত করে। অনেকটা খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বকুল বলে, ‘আমার কথা তোমার মনে পড়ে না?’ ‘কেন পড়বে? পড়ার কি কোনো কারণ আছে?’ খানিকটা ক্ষোভ যেন ঝরে পড়ে মিথিলার মনে। ‘জানো, আমি আমার বাড়ির সামনে বহুবার পলাশগাছ লাগিয়েছি, প্রতিবার ফুল ধরার আগে মরে যায়। কেন বলতে পারো?’ বকুলের প্রশ্নের উত্তরে মিথিলা বলে, ‘পলাশগাছের যত্ন নিতে হয় ভালো করে।’ মিথিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বকুল। সে জানে, তার বুকের ভেতরে যে কষ্ট হচ্ছে কয়েক দিন ধরে, তা সে বলতে পারবে না মিথিলাকে। অথচ তা বলতেই সে এসেছিল। মিথিলা হাসি-খুশি মেয়ে, তবে সে-ও এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবে না, তা-ও সে জানে। তার মনে হয় মিথিলা তার ওপর রাগ করে ছিল এত দিন, এখনো আছে। মিথিলা বলে, ‘তোমার গান গাওয়া কেমন চলছে?’ ‘মাঝেমধ্যে গাই।’ বকুল সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়। বকুল আরও একবার গভীরভাবে তাকায় মিথিলার দিকে। মিথিলা এবার কিছু বলে না। অরণ্যের ছায়া পড়ে তাদের মুখে। সেই ছায়া ঠিক বিষাদের নয়, তবে আনন্দেরও নয়। ছায়া যেমন একটু পরে বিদায় নেবে, তারাও বিদায় নিয়ে চলে যাবে নির্ধারিত ঠিকানায়। থাকবে এই ছায়ামাখা বিকেলের স্মৃতি, সেই স্মৃতি কি মিথিলার মনে থাকবে? বকুলের মনে থাকবে। কারণ তার এসব স্মৃতি বিতাড়িত করার ক্ষমতাই নেই।
সে কখনো ইনসমনিয়ার রোগী ছিল না। গত পঞ্চাশ বছরে এ রকম যে দু-একবার হয়নি, তা নয়। তবে সপ্তাহ খানেক ধরে, বিশেষ করে আজকেরটা তার ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। সে মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। বারান্দায় গিয়ে বসে ইজি চেয়ারটায়। সামনে ছোট একটা জঙ্গলের মতো, তার ওপাশে একটা বড় বিল্ডিং। তার মাথা ছুঁয়ে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ দেখা যাচ্ছে। এখনই হয়তো সে মেঘের আড়ালে যাবে। এখন কি শুক্লপক্ষ? না, তা হবে কেন? কৃষ্ণপক্ষই হবে। কী মনে করে বকুল ছেলেমেয়েদের ঘরের দিকে যায়। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস। রাতে ঘুম ভাঙলে একবার ওদের দেখে আসে। এখন যদিও ওরা বড় হয়েছে। দুই ঘরে দুজন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা একদম বাবার মতো দেখতে হয়েছে। পলি এ নিয়ে প্রায়ই খোঁটা দেয়। ‘বাবার মতো মানে ঢিলেঢালা, অগোছালো, জীবনে কিছুই ভালোভাবে করতে পারবে না। সিম্পলি ক্যালাস।’ বকুল রাগ করে না। কারণ, তার মতো হলেও তো অনেক। তবে মেয়ে তার চেয়ে ভালো হয়েছে। সে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্টে পড়ছে। ছেলেটা এইচএসসি পাস করল। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। ও বুয়েটে পড়তে চায়। দেখা যাক। ছেলের ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার তাকায়। আবার ফিরে আসে বারান্দায়।
একটা গানের কলি মনের মধ্যে ভেসে আসে। মিথিলার সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয় এক গানের আসরে, তখন বকুল কলেজে পড়ত। আর মিথিলা পড়ত ক্লাস নাইনে। ছোট্ট মফস্বল শহরে সবাই সবাইকে চিনত। ওই দিন মিথিলা স্কুলের মাঠে গান গাওয়ার পরে যেন ওকে নতুন করে আবিষ্কার করে বকুল। রবিঠাকুরের একটি গান। গানের পরে ও যখন মিথিলাকে বলে, ‘তোমার গান খুব সুন্দর।’ মিথিলা বলেছিল, ‘মানে কী?’ কিছুটা হকচকিত হয়ে বকুল বলে, ‘মানে, অসম্ভব সুন্দর করে তুমি গানটি গাইলে।’ ‘তাই নাকি? নাকি অন্য কিছু, আমি তো জানি, আমি এই গানটি গাইতেই পারি না। তুমি শুধু শুধু আমাকে প্রশংসা করছ। মতলব কী?’ কোনো কথা বলতে পারছিল না বকুল। তোতলাতে তোতলাতে বলেছিল, ‘না না, আমি তো গানটি জানি, তু-তুমি ভালোই গেয়েছ।’ একটা লাল আভা ওর মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল আর মিথিলা সেটা লক্ষও করেছিল। মিথিলা ওর চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে তখন বলে, ‘আচ্ছা, তুমি তো গান করো, গান লেখোও। তো বলো তো, কিছু পলাশের নেশা আর কিছুটা চাঁপায় মেশা—এর মানে কী? মানে জানলে নাকি এক্সপ্রেশনটা ভালো হয়। আমার ওস্তাদ আমাকে বলেছে।’ এবার আরও বিপদে পড়ে বকুল। সে বলে, ‘এটা তো রবীন্দ্রনাথের গান, আমি ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তবে পলাশ আর চাঁপার প্রকাশিত আনন্দকে প্রেমের অভিব্যক্তির সঙ্গে মিশিয়েছেন কবি।’ মিথিলা বলে, ‘বাহ্! বেশ, ভালো ব্যাখ্যা তো! আর একটু গুছিয়ে বলবে?’ ততক্ষণে বকুল বুঝতে পারে দুটো জিনিস। তাকে নিয়ে মিথিলা মজা করছে। ওর বয়সের চেয়ে ছোট একটা মেয়ে ওকে নিয়ে কেমন খেলছে। সে এ-ও বোঝে যে সে মিথিলার প্রগাঢ় চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। সে তোতলাচ্ছে আর কেমন শিহরিত হচ্ছে। কিছুটা বিব্রত, তবে ভালোও লাগছে। এই অবস্থার নাম যা-ই হোক, আগে সে কখনো এ অবস্থায় পড়েনি। সেদিন সে আর কোনো কথা বাড়ায়নি।
তারপর তাদের অনেক কথা হয়েছে। মিথিলার সঙ্গে স্বাভাবিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়েছে। পড়াশোনা, গান, আবৃত্তি নিয়ে কথা হয়েছে। কেউ কোনো দিন এ নিয়ে কথা বলেনি। কারণ, বাহ্যত তারা গোপন কিছু করেনি। বকুলের বাবা কলেজের অধ্যাপক আর মিথিলার বাবা ছিলেন চিকিৎসক। শিক্ষিত পরিবার বলে তাদের নিয়ে কেউ কোনো কথা বলত না। পাড়ার লোকজনও তেমন কিছু বলত না। বকুল কলেজ পাস করে ঢাকায় চলে গেলে দৃশ্যত তাদের সঙ্গে আর আগের মতো তেমন দেখা হতো না। কোনো বিশেষ উৎসবে বাড়ি এলে দেখা হতো কখনো কখনো। হার্দিক সম্পর্ক ছিল, তবে খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না। তারপর তো বকুল লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নিল, বিয়ে করল পলিকে। ওর খালাতো বোন। সে-ও লেখাপড়ায় বকুলের সমসাময়িক, তবে সে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ছেলেমেয়েদের ঝামেলার জন্য কোনো চাকরি সে করেনি। সংসারের জন্য তার বিশাল টান, বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বকুলকে নিয়ে সে কখনো ভেবেছে বলে তার মনে হয় না। মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটে। বাবা-মা বিয়ে দিয়েছিল, বকুল না করেনি। পলিও আপত্তি করেনি। করলে হয়তো বিয়েটা হতো না। কারণ, পলি সব দিক দিয়ে উপযুক্ত পাত্রী ছিল। যেমন লেখাপড়া, তেমনি ছিল ওর চেহারা। তুলনায় বকুল একটু পিছিয়ে ছিল। চাকরি সে ভালোই পেয়েছিল, তবে রংটা তার উজ্জ্বল ছিল না। পলিকে বিয়ের পর একবার সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিল বকুল, ‘আচ্ছা, আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছিল কেন?’ প্রশ্নটা বোকার মতো। তবু সে করেছিল। উত্তরে পলি বলেছিল, ‘তোমাকে পছন্দ করেছিলাম কে বলল? মোটেও পছন্দ করিনি, তোমার মতো হাদারামকে কে পছন্দ করবে শুনি?’ ‘তাহলে আমি কি ভুল শুনেছিলাম?’ প্রশ্ন করে বকুল পলির দিকে তাকাতেই দেখে সে মিটিমিটি হাসছে। এই বিষয়টা বকুল কখনো বোঝে না। তবে তাকে নিয়ে পলি সব সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এটা ঠিক, আবার যত্নআত্তি তো কম করে না। বিয়ের বিশ বছর পার হলেও মারাত্মক কোনো অঘটন ঘটেনি তাদের মধ্যে। সে হিসেবে সে ভালোই আছে বলতে হবে।
তবে আজ কেন এমন হচ্ছে? বকুলের কেন পলাশের নেশায় টানছে? এ কি স্রেফ নিদ্রাহীনতার কারণে? মিথিলা কেন বারবার ফিরে ফিরে আসছে? সেই চোখ, সেই ভ্রুকুঞ্চন, সেই মৃদু হাসি। সেই বোকা বানানোর মতলব চোখে-মুখে। সে ক্রমশ এটা ভাবতে থাকে যে অন্তত একবার হলেও সে মিথিলার সঙ্গে দেখা করবে। সে জানে কোথায় থাকে সে। প্রয়োজন হয়নি বলে কখনো যায়নি। এখন যেন গলা শুকিয়ে আসছে, বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে। প্রথম পরিচয়ের সময় এ রকম হতো। মাঝে পঁচিশ বছরের মতো ব্যবধান। কী বলবে সে? শুধু দেখা করবে? তার স্বামী কী বলবে? মিথিলা কী বলবে? ভীমরতি? সে হয়তো কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবে না।
সকালে অফিসে গিয়ে কয়েকজনের কাছে ফোন করে সে মিথিলার নম্বর পেল। সারা রাত না ঘুমানোর ক্লান্তি চোখে। একবার মনে হলো আজই যাবে। পরক্ষণে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করল। বাসায় ফিরে বিকেলে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল। ঘুম আসে না। পলিকে বলা যায় কি না, ভাবল। সাহস হলো না। এত দিনে তার প্রবলভাবে মনে হচ্ছে যে সে মিথিলাকে ভালোবাসত। আগেও বহুবার মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, একবার অন্তত কথাটা মিথিলাকে বলা দরকার। পরে মনে হয়েছে, বেচারাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? আগে যখন বলিনি, এখন বলে যন্ত্রণা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কিন্তু মিথিলা সব সময় ভাসছে চোখের সামনে। কাজে ভুল হচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেছে সামলে নিতে, নিজেকে বোঝাতে পারেনি।
পাঁচ দিনের মাথায় একদিন সে পার্কে দেখা করার সুযোগ পেল মিথিলার সঙ্গে। মিথিলা খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। সে বলল, ‘কী ব্যাপার? তুমি এত দিন পরে কী বলতে চাও? পুরোনো প্রেম কি জাগ্রত হলো?’ মিথিলা বেগুনি রঙের একটি শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউজ। এই প্রথম বকুল তাকে শাড়ি পরতে দেখল। বকুল কিছু বলতে পারে না। শুধু বলে, ‘না, কোনো ব্যাপার না। তোমার সঙ্গে কতকাল দেখা হয় না।’ মিথিলা বলে, ‘তুমি কি সংসারজীবনে অসুখী হয়েছ?’ ‘না, নাতো!’ গলাটা হালকা কেঁপে যায় বকুলের। বকুলের মনে হয়, সে প্রথম দিনের মতো দেখছে মিথিলাকে সেই অবগাহনের আনন্দে। সে বেশ সাহস করে তাকায় ওর দিকে। মিথিলা পুরোনো স্বভাবে বলে, ‘বেশ তো, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছ। ভালো সাহস হয়েছে তো দেখছি। কোত্থেকে পেলে সাহস? আসার সময় বউয়ের অনুমতি নিয়ে এসেছ?’ বকুল চুপসে যায়। বলে, ‘তুমি আগের মতোই আছ। আমি ভেবেছিলাম, তুমি বদলে গেছ।’ ‘বদলাব কেন? কার জন্য বদলাব, কার নির্দেশে বদলাব?’ মিথিলা বলে।
বড় অর্জুনগাছের ওপর দিয়ে বিকেলের ম্লান সূর্য ওদের দুজনের মুখে খানিকটা আলো দেয়, খানিকটা প্রাণিত করে। অনেকটা খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বকুল বলে, ‘আমার কথা তোমার মনে পড়ে না?’ ‘কেন পড়বে? পড়ার কি কোনো কারণ আছে?’ খানিকটা ক্ষোভ যেন ঝরে পড়ে মিথিলার মনে। ‘জানো, আমি আমার বাড়ির সামনে বহুবার পলাশগাছ লাগিয়েছি, প্রতিবার ফুল ধরার আগে মরে যায়। কেন বলতে পারো?’ বকুলের প্রশ্নের উত্তরে মিথিলা বলে, ‘পলাশগাছের যত্ন নিতে হয় ভালো করে।’ মিথিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বকুল। সে জানে, তার বুকের ভেতরে যে কষ্ট হচ্ছে কয়েক দিন ধরে, তা সে বলতে পারবে না মিথিলাকে। অথচ তা বলতেই সে এসেছিল। মিথিলা হাসি-খুশি মেয়ে, তবে সে-ও এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবে না, তা-ও সে জানে। তার মনে হয় মিথিলা তার ওপর রাগ করে ছিল এত দিন, এখনো আছে। মিথিলা বলে, ‘তোমার গান গাওয়া কেমন চলছে?’ ‘মাঝেমধ্যে গাই।’ বকুল সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়। বকুল আরও একবার গভীরভাবে তাকায় মিথিলার দিকে। মিথিলা এবার কিছু বলে না। অরণ্যের ছায়া পড়ে তাদের মুখে। সেই ছায়া ঠিক বিষাদের নয়, তবে আনন্দেরও নয়। ছায়া যেমন একটু পরে বিদায় নেবে, তারাও বিদায় নিয়ে চলে যাবে নির্ধারিত ঠিকানায়। থাকবে এই ছায়ামাখা বিকেলের স্মৃতি, সেই স্মৃতি কি মিথিলার মনে থাকবে? বকুলের মনে থাকবে। কারণ তার এসব স্মৃতি বিতাড়িত করার ক্ষমতাই নেই।
No comments:
Post a Comment