Sunday, June 23, 2013

কালু মিয়া ডাকাত দলের সর্দার। দলের বাইরে কালুর আরও কিছু অনুচর আছে। কোন বাসায় স্বর্ণ আছে, ক্যাশ আছে, কোন সময় অপারেশন চালানো যায়, কোন পথে তাড়াতাড়ি সটকে পড়া যায়—এসব খবর সংগ্রহ করা ওদের কাজ।
একদিন ফেন্সি রহিম কালুর ডেরায় হাজির হয়—
: ওস্তাদ, ক্লায়েন্টের বাসা মগবাজারের পেট্রল পাম্পের পেছনের গলিডার মুখে। কালকে ব্যাংক বন্ধ। গার্মেন্টসের বেতন দিব বইলা হালায় ক্যাশ বাসায় আইনা রাখসে।
: হুম্ম।
: দিনে অপারেশন করা টাফ। গলিতে লোক গিজগিজ করে। সামনের রাস্তায়ও জ্যাম। রাইতে করা যায়। তয় রাইতে গলির পুরাটা লাইটে ফকফকা। বাসার গেইটেও ক্যামেরা লাগানো আছে। তয় কারেন্ট না থাকলে সব অফ।
কালুর এক কবির কথা মনে পড়ে। কোনো এক কারণে কবির কিছু পঙিক্ত তার খুব পছন্দ। যদি সম্ভব হতো পঙিক্তগুলো সে একটা কাগজে লিখে তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখত। 
এক কবি বলেছিলেন, ‘লোডশেডিংয়ের দরকার আছে, যাতে মানুষ ভুলে না যায় লোডশেডিং নামে কিছু একটা ছিল।’
অনাবশ্যক হলেও শুধু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে ঘটনা ঘটানো আবশ্যক, সে ঘটনা ঘটাতে তীব্র মোটিভেশন কাজ করে। এ জন্যই লোডশেডিং হবে। দিনেও হবে, রাতেও হবে। কালুর কপালে কোনো ভাঁজ নেই। মৃদু একটা ভাঁজ আছে ঠোঁটের কোণে— 
: টাকাটা কই রাখসে?
: বুয়া কইল শোয়ার ঘরের আলমারিতে।
কালুর আবার কবির কথা মনে হয়। কবি বলেছিলেন, ‘বেডরুমের নিরাপত্তা সরকার দিতে পারবে না।’
কালুর হাসি আসে। এক ফালি গোপালভোগ আমের মতো হাসি। সে ফালির এক কোনা দিয়ে আমের রসের মতো পানের রস গড়িয়ে পড়ে।
: মাল কট্টুক আছে? 
: এক কুটি। ওস্তাদ, এত মাল সরাইলে যদি হুলুস্থুল পইড়া যায়?
ফেন্সি রহিম খালি ফেনসিডিলের খবর রাখে, কবি কী বলেছেন তার খবর নাই। রহিম জানে না এক কবি বলেছিলেন, ‘তিন-চার হাজার কোটি টাকা কোনো ব্যাপার না।’ 
কালু একসময় বাসের হেলপার ছিল। ডেইলি ইনকাম তিন শ। বউ নিয়ে থাকত কমলাপুরের বস্তিতে। ফুটফুটে একটা মেয়েও হয়েছিল বউয়ের। হঠাৎ কী এক অসুখ ধরা পড়ে চার মাসের বাচ্চাটার। প্রতিদিন একটা করে ইনজেকশন দিল ডাক্তার। প্রতিটার দাম ৭০০ টাকা। বাধ্য হয়ে ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একদিন যাত্রীদের সবকিছু হাতিয়ে নেয়। এভাবে কিছুদিন চলে। এই লাইনে রিস্ক বেশি। একদিন ধরা পড়ে কালু। পাবলিকের পিটুনিতে শরীরের কয়েক জায়গায় ছিলে যায়। তিন মাস জেলে থাকায় সে ক্ষত শুকিয়েও যায়। কিন্তু মনের ক্ষত এখনো শুকায়নি কালুর। এখনো গভীর রাতে বউটার মরাকান্না শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে সে। সে কান্না তার বুকে লাঙলের ফলার মতো বিঁধে যায়। নিজেকে অপরাধী মনে হয় কালুর।
রহিম বলে, ‘ওস্তাদ, এত মাল সরাইলে তো ধরা খাওয়ার চান্স আছে। যদি ধরা পইড়া যাই? কায়দা কইরা লুকাইতে হইব।’
রহিমের কথায় বাস্তবে ফেরে কালু। এসব পুলাপাইন ‘কথার কথা’ বোঝে না। ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধী ধরা হবে’, এটাও একটা ‘কথার কথা’। কবিরাও ‘কথার কথা’ বলতে পারেন, তাঁরাও তো মানুষ। 
: ওস্তাদ, ট্যাকাওয়ালা তো সবাই, জানের ভয় বেশি। প্রতিটা ফ্লোরে গার্ড। সিঁড়ি আর লিফটের দরজায়ও গার্ড। ক্যামনে কী...
ভাবার জন্য একটু সময় নেয় কালু। এক কবি একটা কথা বলেছিলেন, কিন্তু এটা কি সম্ভব? না, কবিদের কথায় বিশ্বাস রাখতে হয়।
কালুর মনে বিশ্বাস জন্ম নেয়, ‘পিলার ধরে নাড়ালে বিল্ডিং ধসে পড়ে।’ এতই যেহেতু ঝামেলা, সেহেতু ওপরে ওঠার দরকার কী? বরইগাছে ওঠা অসম্ভব বলেই হয়তো বরইগাছ ঝাঁকি দিলে টপাটপ বরই পড়ে। আমগাছে পড়ে না। কোনোভাবে গেটের দারোয়ানকে কাবু করে নিচতলায় ঢুকলেই ফাইনাল। এরপর দলের সবাই মিলে সর্বশক্তি দিয়ে পিলারগুলো ঝাঁকি দিয়ে দৌড়। তারপর ওপরের শোবার ঘর গড়িয়ে গড়িয়ে ওদের পায়ের কাছে এসে হাজির হলে সবাই মিলে টাকার ব্যাগটা খুঁজে নিয়ে ‘লাগা দৌড়’।

অনাবশ্যক হলেও শুধু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে ঘটনা ঘটানো আবশ্যক, সে ঘটনা ঘটাতে তীব্র মোটিভেশন কাজ করে। এ জন্যই লোডশেডিং হবে। দিনেও হবে, রাতেও হবে। কালুর কপালে কোনো ভাঁজ নেই। মৃদু একটা ভাঁজ আছে ঠোঁটের কোণে।

No comments:

Post a Comment