আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। অষ্টম-নবম শ্রেণীতে পড়ি। বন্ধুর বড় বোন এসএসসি দেবে। তাদের বাসায় মাঝে মাঝে যাই। আমাদের সামনেও আসে না। মা-বাবার কড়া শাসন। বাসা থেকে স্কুল—অল্প কিছুটা রাস্তা, সেটুকুও মাথায় ওড়না জড়িয়ে নজর মাটির দিকে রেখেই হেঁটে যায়। মা-বাবা তৃপ্ত—তাঁদের মেয়ে সঠিক পথে আছে। ‘ছেলে-ছোকরাদের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই।’ একদিন সকালে শুনতে পেলাম, সেই মেয়ে আর পাশের বাসার কলেজপড়ুয়া ছেলে পালিয়ে গেছে। তাদের নাকি অনেক দিন থেকেই মন দেওয়া-নেওয়া চলছিল। রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঘটনা! বড়দের কানাকানি ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’।
এই সময়ের কথা। তন্ময় (ছদ্মনাম) ঠিকমতো পড়ছে কি না, পরীক্ষায় ভালো করছে কি না—এ ব্যাপারে মা তাঁর দিন-রাত উৎসর্গ করেছেন। তিনবেলা ছেলে যেন বেশি বেশি খায়, স্কুল-কোচিং-প্রাইভেট যেন মিস না হয়—মায়ের টেনশনের শেষ নেই। ঘুমানোর আগে ছেলেকে এক গ্লাস দুধ খাইয়েই তবে যেন শান্তি। বাবাও ভাবলেন, ছেলেকে আধুনিক যুগের উপযোগী করতে হবে। তাই ছেলের ঘরে কম্পিউটার, হাতে স্মার্টফোন। তন্ময় জেএসসি পরীক্ষায়ও পেল জিপিএ-৫। মা-বাবার আদর-যত্ন আরও বেড়ে গেল। স্কুল আর বাসা—এর মধ্যেই তন্ময়ের জীবনযাপন। বন্ধুরা ইন্টারনেটে বা ফোনে। নবম শ্রেণীতে তন্ময়ের ফলাফল খারাপ হতে থাকল। ছেলেটা তো ঘরে বসেই পড়ে সারাক্ষণ, তাহলে সমস্যাটা কী? মা-বাবা একদিন উত্তরটা পেয়েও গেলেন। তন্ময় ঝুঁকে পড়েছে মাদকের দিকে।
ছেলেমেয়ের শৈশবকালে যেভাবে তাদের দেখভাল করেন মা-বাবা, ঠিক একই রকম আচরণ করতে চান বয়ঃসন্ধির সময়টাতেও। মা-বাবার চেয়ে সন্তানের ভালো আর কে বোঝে! বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা কোরো না, ওটা কোরো না, এর সঙ্গে মিশবে, ওর সঙ্গে এত কথা কী! এমন প্রচলিত ধারাতেই চলে সন্তান লালন-পালন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম একটা অভিজ্ঞতা শোনালেন। তাঁর কাছে ১৭ বছরের এক ছেলে ও তার মা গেছেন। প্রশ্নোত্তরে জানা গেল, মা তাঁর ছেলেকে এখনো খাবার মুখে তুলে খাওয়ান প্রতি বেলায়। তিনি কেন এটা করেন? মায়ের উত্তর, ‘আমি তুলে খাওয়ালে ও বেশি খায়।’
এ প্রসঙ্গ ধরে মেহতাব খানম বলেন, ‘আমি তখন মাকে বলেছিলাম, এটা করা আপনার ঠিক নয়। ওকে তো স্বাবলম্বী হতে দিতে হবে।’
বয়ঃসন্ধির সময়টাতে (১১-১২ বছর বয়স থেকে শুরু) ছেলেমেয়েদের মধ্যে আবেগ বেশি থাকে। যা-ই করে, বেশি বেশি করতে থাকে। এ সময় তারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (প্রাইভেসি) চায়। তাদের নিজস্ব ড্রয়ার থাকে। অনেক বিষয়ই আর আগের মতো মা-বাবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চায় না। এসব তাদের বয়সের ধর্ম। মেহতাব খানম মনে করেন, এ সময় ছেলেমেয়ের ওপর নিয়মকানুন চাপিয়ে না দেওয়াই ভালো, ‘বরং ওদের সঙ্গে নেগোসিয়েশনে বসা উচিত। বলুন, চলো আমরা দুজনে বসে সব ঠিক করি। এই বয়সে ওদের যদি পড়াশোনা, ক্যারিয়ার বা অর্জন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যায়, তবে ওরাও সেটা বুঝবে। বেশি আদর বা অতিরিক্ত শাসন—কোনোটাই ভালো নয়।’
অনেক সময় বাবা-মায়ের আদর-শাসন, বোঝানো কোনো কিছুই কাজে লাগে না। সামাজিক অনেক কারণ এর জন্য দায়ী—এমনটা মনে করেন ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কস্তুরী দত্ত মজুমদার। তিনি বলেন, ‘যতই বলি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, রাস্তাঘাটের পোস্টার-বিলবোর্ড—এসব থেকে আমরা তো আর এখন বের হতে পারব না। তাই ওদের যতটা সম্ভব সময় দেওয়া উচিত। অনেক সময় কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে মিলে খারাপ কিছু করতে পারে, তখন একই শ্রেণীর অন্য শাখায় ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেও কাজে দেয়।’
ছেলে বা মেয়ে যখন যা চাইবে, তখন তাকে সেটা না দেওয়াই ভালো। এতে ওদের লোভ বেড়ে যাবে। ছোটবেলা থেকেই উচিত মা-বাবার সামর্থ্য বুঝে সন্তানের বায়না মেটানো।
নবম শ্রেণীর ছাত্র রায়ানের বাবা আহমেদ হাসানের কথা শুনি এবার: ‘আমি কোনো কিছুতেই ওকে না করি না। বুঝি, সব বন্ধুর সঙ্গে ওর মেশা ঠিক হচ্ছে না, তবুও বারণ করি না তাদের সঙ্গে মিশতে। ওর মা অবশ্য মাঝে মাঝে সরাসরিই বলে।’
আহমেদ হাসান যেটা করেন, সেটা হলো নিজের বয়ঃসন্ধিকালে যেসব প্রলোভনের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেগুলোর কথা রায়ানকে বলেন। আর বোঝান যে, ‘দেখো, ওই সময় যদি আমি অমুকের কথায় সিগারেট টানতাম, তবে আমার এই এই ক্ষতি হতো।’ এই পদ্ধতির ফলাফল কী? জানালেন, ছেলের মধ্যে বিচার ও বিবেচনাবোধ তৈরি হয়েছে। তবে আহমেদ হাসান স্বীকার করলেন, এই পদ্ধতি কতটা সঠিক, তা বোঝা যাবে আরও পাঁচ-ছয় বছর পর।
মা-বাবার মূল চিন্তাটাই থাকে সন্তানের ভালো একটা ভবিষ্যৎ ঘিরে। তাই তো তাঁরা আদর-শাসনের মধ্যে যান। সন্তানের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেন কিংবা নিজেরাই ঠিক করে নেন সন্তানের কোন আবদার মেটাবেন আর কোনটা মেটাবেন না। কিন্তু বয়ঃসন্ধি থেকে ছেলেমেয়ের মধ্যে যে নিজস্ব সত্তা ও নিজের জগৎ গড়ে ওঠে, সেটাও ভুলে গেলে চলবে না। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও...’ ভাবটা তৈরি হতে থাকে। সেই ভাবটা একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে, ভালোমন্দের ফারাকটা বুঝিয়ে দেওয়া ভালো। আমরা তো আসলে চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা ভালো থাকুক সব সময়—সেটা ওদের পছন্দমতো সঠিক পথে হলে ক্ষতি কী!
এই সময়ের কথা। তন্ময় (ছদ্মনাম) ঠিকমতো পড়ছে কি না, পরীক্ষায় ভালো করছে কি না—এ ব্যাপারে মা তাঁর দিন-রাত উৎসর্গ করেছেন। তিনবেলা ছেলে যেন বেশি বেশি খায়, স্কুল-কোচিং-প্রাইভেট যেন মিস না হয়—মায়ের টেনশনের শেষ নেই। ঘুমানোর আগে ছেলেকে এক গ্লাস দুধ খাইয়েই তবে যেন শান্তি। বাবাও ভাবলেন, ছেলেকে আধুনিক যুগের উপযোগী করতে হবে। তাই ছেলের ঘরে কম্পিউটার, হাতে স্মার্টফোন। তন্ময় জেএসসি পরীক্ষায়ও পেল জিপিএ-৫। মা-বাবার আদর-যত্ন আরও বেড়ে গেল। স্কুল আর বাসা—এর মধ্যেই তন্ময়ের জীবনযাপন। বন্ধুরা ইন্টারনেটে বা ফোনে। নবম শ্রেণীতে তন্ময়ের ফলাফল খারাপ হতে থাকল। ছেলেটা তো ঘরে বসেই পড়ে সারাক্ষণ, তাহলে সমস্যাটা কী? মা-বাবা একদিন উত্তরটা পেয়েও গেলেন। তন্ময় ঝুঁকে পড়েছে মাদকের দিকে।
ছেলেমেয়ের শৈশবকালে যেভাবে তাদের দেখভাল করেন মা-বাবা, ঠিক একই রকম আচরণ করতে চান বয়ঃসন্ধির সময়টাতেও। মা-বাবার চেয়ে সন্তানের ভালো আর কে বোঝে! বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা কোরো না, ওটা কোরো না, এর সঙ্গে মিশবে, ওর সঙ্গে এত কথা কী! এমন প্রচলিত ধারাতেই চলে সন্তান লালন-পালন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম একটা অভিজ্ঞতা শোনালেন। তাঁর কাছে ১৭ বছরের এক ছেলে ও তার মা গেছেন। প্রশ্নোত্তরে জানা গেল, মা তাঁর ছেলেকে এখনো খাবার মুখে তুলে খাওয়ান প্রতি বেলায়। তিনি কেন এটা করেন? মায়ের উত্তর, ‘আমি তুলে খাওয়ালে ও বেশি খায়।’
এ প্রসঙ্গ ধরে মেহতাব খানম বলেন, ‘আমি তখন মাকে বলেছিলাম, এটা করা আপনার ঠিক নয়। ওকে তো স্বাবলম্বী হতে দিতে হবে।’
বয়ঃসন্ধির সময়টাতে (১১-১২ বছর বয়স থেকে শুরু) ছেলেমেয়েদের মধ্যে আবেগ বেশি থাকে। যা-ই করে, বেশি বেশি করতে থাকে। এ সময় তারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (প্রাইভেসি) চায়। তাদের নিজস্ব ড্রয়ার থাকে। অনেক বিষয়ই আর আগের মতো মা-বাবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চায় না। এসব তাদের বয়সের ধর্ম। মেহতাব খানম মনে করেন, এ সময় ছেলেমেয়ের ওপর নিয়মকানুন চাপিয়ে না দেওয়াই ভালো, ‘বরং ওদের সঙ্গে নেগোসিয়েশনে বসা উচিত। বলুন, চলো আমরা দুজনে বসে সব ঠিক করি। এই বয়সে ওদের যদি পড়াশোনা, ক্যারিয়ার বা অর্জন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যায়, তবে ওরাও সেটা বুঝবে। বেশি আদর বা অতিরিক্ত শাসন—কোনোটাই ভালো নয়।’
অনেক সময় বাবা-মায়ের আদর-শাসন, বোঝানো কোনো কিছুই কাজে লাগে না। সামাজিক অনেক কারণ এর জন্য দায়ী—এমনটা মনে করেন ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কস্তুরী দত্ত মজুমদার। তিনি বলেন, ‘যতই বলি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, রাস্তাঘাটের পোস্টার-বিলবোর্ড—এসব থেকে আমরা তো আর এখন বের হতে পারব না। তাই ওদের যতটা সম্ভব সময় দেওয়া উচিত। অনেক সময় কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে মিলে খারাপ কিছু করতে পারে, তখন একই শ্রেণীর অন্য শাখায় ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেও কাজে দেয়।’
ছেলে বা মেয়ে যখন যা চাইবে, তখন তাকে সেটা না দেওয়াই ভালো। এতে ওদের লোভ বেড়ে যাবে। ছোটবেলা থেকেই উচিত মা-বাবার সামর্থ্য বুঝে সন্তানের বায়না মেটানো।
নবম শ্রেণীর ছাত্র রায়ানের বাবা আহমেদ হাসানের কথা শুনি এবার: ‘আমি কোনো কিছুতেই ওকে না করি না। বুঝি, সব বন্ধুর সঙ্গে ওর মেশা ঠিক হচ্ছে না, তবুও বারণ করি না তাদের সঙ্গে মিশতে। ওর মা অবশ্য মাঝে মাঝে সরাসরিই বলে।’
আহমেদ হাসান যেটা করেন, সেটা হলো নিজের বয়ঃসন্ধিকালে যেসব প্রলোভনের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেগুলোর কথা রায়ানকে বলেন। আর বোঝান যে, ‘দেখো, ওই সময় যদি আমি অমুকের কথায় সিগারেট টানতাম, তবে আমার এই এই ক্ষতি হতো।’ এই পদ্ধতির ফলাফল কী? জানালেন, ছেলের মধ্যে বিচার ও বিবেচনাবোধ তৈরি হয়েছে। তবে আহমেদ হাসান স্বীকার করলেন, এই পদ্ধতি কতটা সঠিক, তা বোঝা যাবে আরও পাঁচ-ছয় বছর পর।
মা-বাবার মূল চিন্তাটাই থাকে সন্তানের ভালো একটা ভবিষ্যৎ ঘিরে। তাই তো তাঁরা আদর-শাসনের মধ্যে যান। সন্তানের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেন কিংবা নিজেরাই ঠিক করে নেন সন্তানের কোন আবদার মেটাবেন আর কোনটা মেটাবেন না। কিন্তু বয়ঃসন্ধি থেকে ছেলেমেয়ের মধ্যে যে নিজস্ব সত্তা ও নিজের জগৎ গড়ে ওঠে, সেটাও ভুলে গেলে চলবে না। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও...’ ভাবটা তৈরি হতে থাকে। সেই ভাবটা একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে, ভালোমন্দের ফারাকটা বুঝিয়ে দেওয়া ভালো। আমরা তো আসলে চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা ভালো থাকুক সব সময়—সেটা ওদের পছন্দমতো সঠিক পথে হলে ক্ষতি কী!
No comments:
Post a Comment