দুই নেত্রী ও ‘দুই ঘণ্টা’র প্রহসন
তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। কিন্তু তিনটিই প্রহসনমূলক। প্রথমত, মুলতবি প্রস্তাব। সংসদীয় রীতি হলো, সরকারি ব্যর্থতার বিরুদ্ধে তিরস্কার জানাতেই মুলতবি প্রস্তাব আনা হয়। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসবিষয়ক একটি মুলতবি প্রস্তাবের আলোচনার বিষয়ে ১৯৯১ সালের ২৮ অক্টোবর দুই দল সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিরল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বর্তমানে দেখার বিষয় হলো, সরকারের নিন্দা করতে বিএনপির সংসদীয় অরুচি দেখা গেছে। আর তাতে ‘উদ্বিগ্ন’ প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি দলের লোকেরা আহা আহা বলে আক্ষেপ করছেন। বাংলাদেশ ছাড়া এমন দৃশ্য কোথায় মিলবে! প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটি প্রত্যাহার করার ফলে জাতি দেখেছে যে বিএনপি আলোচনা চায় না।’ সরকারকে নিন্দা জানানোর প্রস্তাবটি পুনরায় আনতে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছেন সৈয়দ আশরাফসহ সরকারের বরকন্দাজরা। নির্বাচিত ‘গণতন্ত্র’ এতটাই ঠেকায় ফেলেছে যে এ ধরনের অজ্ঞতাপ্রসূত কর্মকাণ্ডকেও আমাদের বাহবা দিয়ে যেতে হবে। কারণ, যেকোনোভাবে হোক সমঝোতায় পৌঁছানো হলো গণতন্ত্রের কলা!
দ্বিতীয়ত, বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ৬ জুন খবর দিয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় দলীয় সভানেত্রী বলেছেন যে আগামী ২৫ অক্টোবর নবম সংসদের শেষ বৈঠকটি বসবে।’ এটি অজ্ঞাতনামা সূত্রের খবর। এই সূত্র এখনো পর্দার আড়ালে। হাতে সময় মাত্র মাস ছয়েক। তদুপরি সংসদ রেখে কিংবা না রেখে নির্বাচন হবে, এ নিয়ে লুকোচুরি চলছেই। তৃতীয়ত, শাসক দলের তরফে একটি রাজনৈতিক বদলার মনোভাব স্পষ্ট করা। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি একটানা পাঁচ বছরের বেশি ক্ষমতা ভোগ করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই এমন ভোগবঞ্চিত। তারাই একমাত্র দল, যারা পঁচাত্তরের পরে তাদের দলের সরকারের অধীনে সংসদ গঠন করার সুযোগ পায়নি। গণভবনে ৮ জুন শরীয়তপুরের দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই মনোভাব স্পষ্ট করেন এভাবে: ‘সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে অন্তত একবার এ ধারাবাহিকতা শুরু করতে হবে। এবার আমরা তা করবই।’
গণভবনকে প্রধানমন্ত্রী অনেকটা দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছেন। সেখান থেকেই নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলছে। ২০১৩ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতির হিসাব-নিকাশের সাল। আকস্মিক কিছু না ঘটলে সংলাপ না-ও হতে পারে। হলেও তাতে সুরাহা মিলবে না। আওয়ামী লীগ হয়তো আরও তীব্র কণ্ঠে বলবে, নতুন ইতিহাস গড়ছে বাংলাদেশ। একটি নির্বাচিত সরকার থেকে আরেকটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটছে। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া নির্দিষ্টভাবে এর সমালোচনা করতে অপরাগ। কারণ, তিনি ও তাঁর দল স্বাধীন বাংলাদেশে যা একাধিকবার করেছেন, আওয়ামী লীগ তা একবারের জন্যও পারবে না কেন।
আমরা মনে রাখব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় স্থায়ী করে রাখতে সংবিধানপ্রণেতারা এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন, যা সংসদীয় রীতিনীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল; বিশেষ করে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ রক্ষাকবচ দেওয়া হয়। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী আজ কাউকে তোয়াক্কা না করে নির্দিষ্ট করে বলছেন, কবে সংসদ ভেঙে যাবে। প্রধানমন্ত্রী এখন তাঁর দলের আস্থাভাজন রাষ্ট্রপতির নামটি নিতেও নারাজ। রাজি থাকলে শেখ হাসিনা বলতেন, ২৫ অক্টোবরে তিনি সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ দেবেন। হয়তো দলের সভায় তিনি তা-ই বলেছেন, প্রতিবেদনের বিবরণ যথার্থ নয়।
সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট বিবৃতি আসা উচিত। কারণ, ‘নির্বাচিত থেকে নির্বাচিতের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর’, নাকি ‘ব্যক্তি শেখ হাসিনার কাছ থেকে শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর’, সেটা আমাদের জানার অধিকার আছে। দুইয়ের মধ্যে বিরাট তফাত ঘটতে পারে। বিরোধী দলের দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে তাতে বিরোধী দলের বেঞ্চেই থাকতে হলে অমন অবাধ নির্বাচন তাদের চাইনে। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা সংসদের আগাম বিদায়ঘণ্টা বাজানো সাংবিধানিক কি অসাংবিধানিক, তা নিয়ে বক্তব্য দিতে বিরোধীদলীয় নেতার কোনো ইচ্ছা নেই; বরং দলের নেতারা এ নিয়ে কথা তুললে বিএনপির মুখে চুনকালি পড়বে। মুজিবই স্বৈরশাসক ছিলেন, তিনি একদলীয় শাসন চাপিয়েছিলেন, এই স্লোগান দিয়ে ‘ক্যারিশমেটিক’ জিয়াউর রহমান তথাকথিত গণভোটের বৈতরণি পার হন। অথচ তাঁর বহুদলীয় গণতন্ত্রও ছিল ‘একদলীয়’ এবং তা এই অর্থে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিকানা শতকরা ১০০ ভাগই সরকারি দলের প্রযত্নে থাকবে। লেবাসটা যখন যা-ই হোক, বাংলাদেশ মোটামুটি সব সময় এক ব্যক্তি বা একদলীয় শাসনের মন্ত্রে চলে আসছে।
প্রধানমন্ত্রীর আগাম সংসদ ভঙ্গ করার ঘোষণা কি সংবিধানবিরোধী? সংবিধানের আলোকে এটা পরস্পরবিরোধী উপায়ে ব্যাখ্যা করা চলে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সামনে রেখে সংবিধান সৃষ্টি করার খেসারত জাতিকে দিতে হচ্ছে। তবে এই পাপ স্খলন না করার চূড়ান্ত দায় প্রত্যেক নির্বাচিত স্বৈরশাসকের। বাহাত্তরে এটা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে পুরো পাঁচ বছরই মুজিব প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। পাঁচ বছর পরে সংসদ ভেঙে গেলে নতুন নির্বাচনেও মুজিবই জিতবেন। সেটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আগের সংসদসহ মুজিবের প্রধানমন্ত্রিত্ব টিকে থাকবে। নতুন সংসদ স্বীকৃতি পাবে না। এখনো অবস্থাটি তাই।
সংবিধান অনুযায়ী এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঠিক নয় যে সংসদের মেয়াদ পাকাপাকি পাঁচ বছর। এটা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানির্ভর। তিনি যে-কারও সদস্যের পদ খেতে পারেন। আবার যখন-তখন সংসদটাও ভেঙে দিতে পারেন। পুরোটাই তাঁর খেয়াল-খুশিনির্ভর। সংবিধানকে অন্তত এভাবে ব্যাখা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একাই যদি মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে সংসদ ভাঙতে পারেন, তাহলে একটি সংসদ গঠনের ৯০ দিন পরও সংসদ ভাঙতে পারেন। এই ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকবে কি না, সে বিষয়ে বিএনপির মত আমরা পাই না। এটা গণবিরোধী দেউলে রাজনীতিরই নমুনা। প্রথম আলোর জরিপে ৯০ শতাংশ মানুষের তত্ত্বাবধায়ক চাওয়া এবং বিএনপির তাতে আহ্লাদে আটখানা হওয়াটাও প্রকারান্তরে ওই দেউলে রাজনীতিরই অংশ।
চলতি সংসদ ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আপনাআপনি ভেঙে যাবে। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন। সংসদ ভেঙে আগাম নির্বাচন করতে চাইলে পদত্যাগই তাঁর একমাত্র সহি বিকল্প বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সংসদ ভঙ্গ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে তাঁর শূন্য পদে নির্বাচন করতে বাধ্য। তাই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা ও পদত্যাগ না করে সংসদ ভঙ্গের পরামর্শদানের মধ্যে বিরাট তফাত। শেখ হাসিনা সংসদ ভেঙে দিতেই পরামর্শ দেবেন, হয়তো পদত্যাগের ঝুঁকিতে যাবেন না। পদত্যাগ বা সংসদ ভঙ্গ হওয়ার কারণে তাঁর পদশূন্যতায় কিছু যায়-আসে না। কারণ, তিনি তাঁর উত্তরসূরি না আসা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তাঁর মন্ত্রিসভাও অটুট থাকবে। কোনো আইনবলে তাঁকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বলা যাবে না। সংসদীয় রেওয়াজ হলো, ২৫ অক্টোবরে রাষ্ট্রপতিকে উত্তরসূরি খুঁজতে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
‘লগি-বইঠার’ নবতর উপাখ্যান তৈরি হলেও নির্বাচন কমিশন জমিদারের গোমস্তার মতো হুকুমবরদার হতে পারে। তারা সুপ্রিম কোর্টের কাছে দুই মেয়াদের শর্তপূরণ প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের জন্যও বলতে পারে।
তবে সংসদ অচল থাকার কারণে সংসদীয় রীতিনীতির অনুশীলনে এমনিতেই আকাল চলছিল। কিন্তু মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে মনে হলো সংসদীয় রীতি অনুসরণে একটা দুর্ভিক্ষ চলছে। ‘অন্যান্য গণতন্ত্র’ বলে আমরা মুখে ফেনা তুলছি। কিন্তু বিশ্বের কাছে উপহাসের পাত্রে পরিণত হচ্ছি। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও যেন ‘মুলতবি মৎস্য’ শিকার করতে না পারার জন্য আক্ষেপ করছেন। নির্বাচনকালীন সরকারের মতো জাতীয় জ্বলন্ত বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব এনে এবং সে বিষয়ে তামাশা করার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় সরকারি দলের আফসোস কিংবা হুংকার শুনে বলতে ইচ্ছে হয়, ধরণি তুমি দ্বিধা হও।
এত বড় একটি বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব আনা ছিল প্রহসন। এটা হাতছাড়া হওয়ার জন্য আক্ষেপও প্রহসন। এটা ফিরিয়ে আনতে বলা আরও বড় প্রহসন। আসলে কোনো পক্ষই সংলাপ চায়, তা মনে হয় না। বিএনপির নোটিশদাতা সাংসদ মাহবুব উদ্দিন সময় টিভিতে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সংসদে এসে আলোচনা করার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এটা হলো তার প্রতি একটা সমর্থন।’ এটা একটা ইতিবাচক মনোভাব ছিল। প্রস্তাবটি হয়তো মন্দের ভালো ছিল। তারপর কী যে হলো। বোঝা গেল দলনেতা মত পাল্টেছেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে ২৫ জন সাংসদ একটি নোটিশে সায় দিয়েছেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মানুষকে কত বোকা ভাবে, তার প্রমাণ মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে বাহানা করা। পঞ্চম সংসদে আওয়ামী লীগের যুক্তি ছিল মুলতবি প্রস্তাব তো সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব। তাই সরকারি দলের কেউ এর আলোচনায় অংশ নিতে পারবেন না। বাস্তবেও এতে বিরোধী দলেরই প্রাধান্য থাকে। সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী কেবল স্পিকারই মুলতবি প্রস্তাবের ভাগ্যনিয়ন্তা। অথচ সংসদ নেতা আইন লঙ্ঘন করে কী অবলীলায় বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ’ ও ‘সংসদীয় কার্য উপদেষ্টা কমিটি’ এ বিষয়ে সংসদে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এটা জেনে তারা কেটে পড়েছে। তবে প্রহসন চরম রূপ নেয় যখন প্রধানমন্ত্রী জাতিকে বলেন, মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহারের ফলে আলোচনার পথ বন্ধ হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘জাতির সামনে বিএনপি প্রতারণা করেছে। আলোচনার আর সুযোগ নেই।’
প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ আশরাফের কথা শুনে বিএনপি যদি ফের মুলতবি প্রস্তাব আনে, তাহলে কী হবে? সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধির ৬৫ বিধির ২ উপবিধি বলেছে, ‘অনধিক দুই ঘণ্টা কাল প্রস্তাবটি আলোচিত হইবে।’ কোনো পাগলেও কি বিশ্বাস করবে যে অন্তর্বর্তীকালীন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক—এটা ‘অনধিক দুই ঘণ্টা’ আলোচনা করার মতো একটি বিষয়? বিএনপি ও তার মিত্ররা বলছে, সরকারি ‘ফাঁদে’ তারা পা দেয়নি। এই প্রস্তাব তো কণ্ঠভোটে নাকচ হবে। তাহলে তারা আলোচনার আরও বহু সংসদীয় উপায় থাকতে কেন ‘দুই ঘণ্টা’র একাঙ্কিকা মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিল?
সরকারি ও বিরোধী দল আগে ছিল জাতে মাতাল তালে ঠিক। এখন যেন তাদের মধ্যে জাতেও মাতাল, তালেও মাতাল হওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠছে।
গণভবনকে প্রধানমন্ত্রী অনেকটা দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছেন। সেখান থেকেই নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলছে। ২০১৩ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতির হিসাব-নিকাশের সাল। আকস্মিক কিছু না ঘটলে সংলাপ না-ও হতে পারে। হলেও তাতে সুরাহা মিলবে না। আওয়ামী লীগ হয়তো আরও তীব্র কণ্ঠে বলবে, নতুন ইতিহাস গড়ছে বাংলাদেশ। একটি নির্বাচিত সরকার থেকে আরেকটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটছে। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া নির্দিষ্টভাবে এর সমালোচনা করতে অপরাগ। কারণ, তিনি ও তাঁর দল স্বাধীন বাংলাদেশে যা একাধিকবার করেছেন, আওয়ামী লীগ তা একবারের জন্যও পারবে না কেন।
আমরা মনে রাখব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় স্থায়ী করে রাখতে সংবিধানপ্রণেতারা এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন, যা সংসদীয় রীতিনীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল; বিশেষ করে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ রক্ষাকবচ দেওয়া হয়। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী আজ কাউকে তোয়াক্কা না করে নির্দিষ্ট করে বলছেন, কবে সংসদ ভেঙে যাবে। প্রধানমন্ত্রী এখন তাঁর দলের আস্থাভাজন রাষ্ট্রপতির নামটি নিতেও নারাজ। রাজি থাকলে শেখ হাসিনা বলতেন, ২৫ অক্টোবরে তিনি সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ দেবেন। হয়তো দলের সভায় তিনি তা-ই বলেছেন, প্রতিবেদনের বিবরণ যথার্থ নয়।
সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট বিবৃতি আসা উচিত। কারণ, ‘নির্বাচিত থেকে নির্বাচিতের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর’, নাকি ‘ব্যক্তি শেখ হাসিনার কাছ থেকে শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর’, সেটা আমাদের জানার অধিকার আছে। দুইয়ের মধ্যে বিরাট তফাত ঘটতে পারে। বিরোধী দলের দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে তাতে বিরোধী দলের বেঞ্চেই থাকতে হলে অমন অবাধ নির্বাচন তাদের চাইনে। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা সংসদের আগাম বিদায়ঘণ্টা বাজানো সাংবিধানিক কি অসাংবিধানিক, তা নিয়ে বক্তব্য দিতে বিরোধীদলীয় নেতার কোনো ইচ্ছা নেই; বরং দলের নেতারা এ নিয়ে কথা তুললে বিএনপির মুখে চুনকালি পড়বে। মুজিবই স্বৈরশাসক ছিলেন, তিনি একদলীয় শাসন চাপিয়েছিলেন, এই স্লোগান দিয়ে ‘ক্যারিশমেটিক’ জিয়াউর রহমান তথাকথিত গণভোটের বৈতরণি পার হন। অথচ তাঁর বহুদলীয় গণতন্ত্রও ছিল ‘একদলীয়’ এবং তা এই অর্থে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিকানা শতকরা ১০০ ভাগই সরকারি দলের প্রযত্নে থাকবে। লেবাসটা যখন যা-ই হোক, বাংলাদেশ মোটামুটি সব সময় এক ব্যক্তি বা একদলীয় শাসনের মন্ত্রে চলে আসছে।
প্রধানমন্ত্রীর আগাম সংসদ ভঙ্গ করার ঘোষণা কি সংবিধানবিরোধী? সংবিধানের আলোকে এটা পরস্পরবিরোধী উপায়ে ব্যাখ্যা করা চলে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সামনে রেখে সংবিধান সৃষ্টি করার খেসারত জাতিকে দিতে হচ্ছে। তবে এই পাপ স্খলন না করার চূড়ান্ত দায় প্রত্যেক নির্বাচিত স্বৈরশাসকের। বাহাত্তরে এটা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে পুরো পাঁচ বছরই মুজিব প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। পাঁচ বছর পরে সংসদ ভেঙে গেলে নতুন নির্বাচনেও মুজিবই জিতবেন। সেটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আগের সংসদসহ মুজিবের প্রধানমন্ত্রিত্ব টিকে থাকবে। নতুন সংসদ স্বীকৃতি পাবে না। এখনো অবস্থাটি তাই।
সংবিধান অনুযায়ী এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঠিক নয় যে সংসদের মেয়াদ পাকাপাকি পাঁচ বছর। এটা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানির্ভর। তিনি যে-কারও সদস্যের পদ খেতে পারেন। আবার যখন-তখন সংসদটাও ভেঙে দিতে পারেন। পুরোটাই তাঁর খেয়াল-খুশিনির্ভর। সংবিধানকে অন্তত এভাবে ব্যাখা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একাই যদি মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে সংসদ ভাঙতে পারেন, তাহলে একটি সংসদ গঠনের ৯০ দিন পরও সংসদ ভাঙতে পারেন। এই ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকবে কি না, সে বিষয়ে বিএনপির মত আমরা পাই না। এটা গণবিরোধী দেউলে রাজনীতিরই নমুনা। প্রথম আলোর জরিপে ৯০ শতাংশ মানুষের তত্ত্বাবধায়ক চাওয়া এবং বিএনপির তাতে আহ্লাদে আটখানা হওয়াটাও প্রকারান্তরে ওই দেউলে রাজনীতিরই অংশ।
চলতি সংসদ ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আপনাআপনি ভেঙে যাবে। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন। সংসদ ভেঙে আগাম নির্বাচন করতে চাইলে পদত্যাগই তাঁর একমাত্র সহি বিকল্প বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সংসদ ভঙ্গ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে তাঁর শূন্য পদে নির্বাচন করতে বাধ্য। তাই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা ও পদত্যাগ না করে সংসদ ভঙ্গের পরামর্শদানের মধ্যে বিরাট তফাত। শেখ হাসিনা সংসদ ভেঙে দিতেই পরামর্শ দেবেন, হয়তো পদত্যাগের ঝুঁকিতে যাবেন না। পদত্যাগ বা সংসদ ভঙ্গ হওয়ার কারণে তাঁর পদশূন্যতায় কিছু যায়-আসে না। কারণ, তিনি তাঁর উত্তরসূরি না আসা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তাঁর মন্ত্রিসভাও অটুট থাকবে। কোনো আইনবলে তাঁকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বলা যাবে না। সংসদীয় রেওয়াজ হলো, ২৫ অক্টোবরে রাষ্ট্রপতিকে উত্তরসূরি খুঁজতে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
‘লগি-বইঠার’ নবতর উপাখ্যান তৈরি হলেও নির্বাচন কমিশন জমিদারের গোমস্তার মতো হুকুমবরদার হতে পারে। তারা সুপ্রিম কোর্টের কাছে দুই মেয়াদের শর্তপূরণ প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের জন্যও বলতে পারে।
তবে সংসদ অচল থাকার কারণে সংসদীয় রীতিনীতির অনুশীলনে এমনিতেই আকাল চলছিল। কিন্তু মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে মনে হলো সংসদীয় রীতি অনুসরণে একটা দুর্ভিক্ষ চলছে। ‘অন্যান্য গণতন্ত্র’ বলে আমরা মুখে ফেনা তুলছি। কিন্তু বিশ্বের কাছে উপহাসের পাত্রে পরিণত হচ্ছি। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও যেন ‘মুলতবি মৎস্য’ শিকার করতে না পারার জন্য আক্ষেপ করছেন। নির্বাচনকালীন সরকারের মতো জাতীয় জ্বলন্ত বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব এনে এবং সে বিষয়ে তামাশা করার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় সরকারি দলের আফসোস কিংবা হুংকার শুনে বলতে ইচ্ছে হয়, ধরণি তুমি দ্বিধা হও।
এত বড় একটি বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব আনা ছিল প্রহসন। এটা হাতছাড়া হওয়ার জন্য আক্ষেপও প্রহসন। এটা ফিরিয়ে আনতে বলা আরও বড় প্রহসন। আসলে কোনো পক্ষই সংলাপ চায়, তা মনে হয় না। বিএনপির নোটিশদাতা সাংসদ মাহবুব উদ্দিন সময় টিভিতে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সংসদে এসে আলোচনা করার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এটা হলো তার প্রতি একটা সমর্থন।’ এটা একটা ইতিবাচক মনোভাব ছিল। প্রস্তাবটি হয়তো মন্দের ভালো ছিল। তারপর কী যে হলো। বোঝা গেল দলনেতা মত পাল্টেছেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে ২৫ জন সাংসদ একটি নোটিশে সায় দিয়েছেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মানুষকে কত বোকা ভাবে, তার প্রমাণ মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে বাহানা করা। পঞ্চম সংসদে আওয়ামী লীগের যুক্তি ছিল মুলতবি প্রস্তাব তো সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব। তাই সরকারি দলের কেউ এর আলোচনায় অংশ নিতে পারবেন না। বাস্তবেও এতে বিরোধী দলেরই প্রাধান্য থাকে। সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী কেবল স্পিকারই মুলতবি প্রস্তাবের ভাগ্যনিয়ন্তা। অথচ সংসদ নেতা আইন লঙ্ঘন করে কী অবলীলায় বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ’ ও ‘সংসদীয় কার্য উপদেষ্টা কমিটি’ এ বিষয়ে সংসদে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এটা জেনে তারা কেটে পড়েছে। তবে প্রহসন চরম রূপ নেয় যখন প্রধানমন্ত্রী জাতিকে বলেন, মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহারের ফলে আলোচনার পথ বন্ধ হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘জাতির সামনে বিএনপি প্রতারণা করেছে। আলোচনার আর সুযোগ নেই।’
প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ আশরাফের কথা শুনে বিএনপি যদি ফের মুলতবি প্রস্তাব আনে, তাহলে কী হবে? সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধির ৬৫ বিধির ২ উপবিধি বলেছে, ‘অনধিক দুই ঘণ্টা কাল প্রস্তাবটি আলোচিত হইবে।’ কোনো পাগলেও কি বিশ্বাস করবে যে অন্তর্বর্তীকালীন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক—এটা ‘অনধিক দুই ঘণ্টা’ আলোচনা করার মতো একটি বিষয়? বিএনপি ও তার মিত্ররা বলছে, সরকারি ‘ফাঁদে’ তারা পা দেয়নি। এই প্রস্তাব তো কণ্ঠভোটে নাকচ হবে। তাহলে তারা আলোচনার আরও বহু সংসদীয় উপায় থাকতে কেন ‘দুই ঘণ্টা’র একাঙ্কিকা মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিল?
সরকারি ও বিরোধী দল আগে ছিল জাতে মাতাল তালে ঠিক। এখন যেন তাদের মধ্যে জাতেও মাতাল, তালেও মাতাল হওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠছে।
No comments:
Post a Comment