[ রা ষ্ট্র চি ন্তা ]প্রধানমন্ত্রী পদের সাংবিধানিক একনায়কত্ব নাকি ডিফেক্টো একনায়কত্ব?
কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান
একবার কনজারভেটিভ পার্টি নির্বাচনে প্রচারণা চালায় যে, লেবার পার্টি যদি কমন্সসভায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন পায় তাহলে ব্রিটেনে নির্বাচনীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সংসদীয় ব্যবস্থায় নির্বাচনীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সে সম্ভাবনা সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটেনেও তৈরি হয়েছিল। রিচার্ড হেইলসাম সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে নির্বাচনীয় একনায়কত্ব শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি তার এক বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'আমরা একটি নির্বাচনী একনায়কত্বের অধীনে বাস করছি'। হেইলসাম বলেছিলেন, আইন বিভাগ যে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে তা অসহনীয়। বাংলাদেশে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে যথাক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় নির্বাচনীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনেকে এটাকে প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক একনায়কত্বও বলতে চান। তবে হেইলসাম সংসদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতায় শঙ্কিত হলেও বাংলাদেশে বাস্তবে সংসদ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ একটি অফিস কক্ষে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যাকে আমি এই আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ও ডিফেক্টো (বাস্তব) একনায়কত্ব বলতে চাই। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা, স্কটল্যান্ডেও এই রাজনৈতিক একনায়কত্বের বিষয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। কেনিয়ার ন্যাশনাল এসেম্বলীর অফিসিয়াল রেকর্ড পড়েছিলাম। ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালের এক সংসদীয় বিতর্কে জনাব গিথেই (মন্ত্রী) বলেন যে, 'একনায়কত্ব সর্বসময় একনায়কত্ব। সংসদীয় একনায়কত্ব ও শাসন বিভাগীয় একনায়কত্বের মধ্যে কোনো তফাত নেই'। সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক একনায়কত্বের বিষয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে এই বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে সেই সুযোগ আমারও রয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে এতো বেশি ক্ষমতা প্রদান করেছে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিকভাবে একনায়ক হয়ে উঠেছেন। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করবেন। এক্ষেত্রে কোন বিষয়ে তিনি পরামর্শ দিবেন তা উল্লেখ নেই। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী সকল কাজের ক্ষেত্রেই পরামর্শ দেয়ার নীতি অনুসরণ করলে সাংবিধানিকভাবে কোনো সমস্যা হয় না এবং এই পরামর্শের বিষয়ে কোর্টে যাওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতির বিষয়ে অবহিত করবেন (অনুচ্ছেদ ৪৮(৫))। ৫০(১) বলা আছে, রাষ্ট্রপতি কোনোভাবেই দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। সেটা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া, অনুচ্ছেদ ৫২- এর ৫৩ অনুসারে রাষ্ট্রপতির অপসারণ নির্ভর করে সংসদ সদস্যদের উপর এবং যেহেতু প্রধানমন্ত্রীই সংসদ নেতা এবং সংসদের অধিকাংশ সদস্য তার দলের (যে দলেরও তিনি নেতা) সেহেতু রাষ্ট্রপতি পদে থাকাটাও অনেকাংশে তার উপরই নির্ভর করছে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর আস্থা বিনষ্ট করার চেষ্টা করলে অথবা প্রধানমন্ত্রীও তার দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে প্রধানমন্ত্রী তার দলের সংসদ সদস্যদের কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপসারণ করতে পারেন। এভাবে তিনিই প্রকারান্তরে রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত হওয়া বা থাকার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি পদে এমন কাউকেই মনোনীত করেন না যিনি তার এবং তার দলের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন না। এজন্য প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে নামসর্বস্ব নয় রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ অফিসারে পরিণত হয়ে থাকেন কিনা সে প্রশ্ন উঠে। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের আস্থাভাজন না হলে রাষ্ট্রপতির ভাগ্য কী পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকে সেটা বোঝা যায় ২০০১ সালের পর তত্কালীন রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে। তিনি সংবিধানের ৫২ ও ৫৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো অপরাধ না করেও রাষ্ট্রপতি পদ থেকে উত্খাত হয়েছেন। কিন্তু গ্রেটবৃটেনে রানির পদে আসাটা এবং থাকাটা ঐতিহ্যগতভাবেই সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন থাকার উপর নির্ভর করে না। তাই ব্রিটেনে রাষ্ট্র ও জনগণের অধিকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে বাস্তবে রানির আস্থাভাজন হতে হয়। বাংলাদেশে বাস্তবে ক্ষমতাসীন দলের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হতে হয়। তাই বাংলাদেশে দলীয় বিবেচনায় কোনো ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে নোট প্রেরণ করলে রাষ্ট্রপতি ভিন্ন বিবেচনা থাকলেও পদে থাকতে হলে তাকে অবশ্যই সরকার গঠনকারী দল তথা প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন থেকে ঐ ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ মওকুফ করে দিতে হবে। তাছাড়া সাংবিধানিকভাবে প্রধান সেনাপতি (অনুচ্ছেদ ৬১), এটর্নি জেনারেল (অনুচ্ছেদ ৬৪), কন্ট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল (অনুচ্ছেদ ১২৭(১)), পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের (অনুচ্ছেদ ১৩৮(১)) নিয়োগ দান, বিচারকদের নিয়োগদান ও অন্যান্য ক্ষমতা (অনুচ্ছেদ ৯৫ ও ৯৬(৩)), জরুরি অবস্থা জারির (১৪১(ক)(১) অনুচ্ছেদ) ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকলেও বাস্তবে এ সকল ক্ষমতা প্রয়োগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শই অনুসরণ করেন শুধুমাত্র তার পদ রক্ষার জন্য। এভাবে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রে স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি থাকেন না। সবাই (এমনকি প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও) কোনো না কোনোভাবে প্রধানমন্ত্রীরই অফিসারে রূপান্তরিত হন। এক্ষেত্রে নতুন কোনো আইনি কাঠামো বা (তথা ব্রিটেনের মতো রাজা/রানির বিধান) বা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সদিচ্ছা, সততা ও আন্তরিকতাই এই অবস্থানকে রোধ করতে পারে। অর্থাত্ যতক্ষণ পর্যন্ত দলের নেতা, সরকার প্রধান, সংসদ নেতার (একই ব্যক্তি) উপর রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়া এবং থাকা, এমনকি দলে থাকাটাও নির্ভর করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীই প্রভু, অন্য সবাই তার আজ্ঞাবহ (বাস্তবে)। তবে এখানে আমি সেই পুরাতন রাজা/রানির বিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলছি না। প্রধানমন্ত্রীকে তার দল থেকে সাংবিধানিকভাবে আলাদা করলে অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি আর দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না এবং দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এই বিষয়টি নিশ্চিত করলেই এই অবস্থায় সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৫(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা অনুশীলন হবে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে। তবে ৫৫(৩) অনুসারে প্রধানমন্ত্রী ও তার কেবিনেট এই শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সংসদের নিকট দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কোনোভাবেই এই দায়বদ্ধতা তৈরি করতে পারে না। গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখা গেছে সংসদ আসলে সরকারি দলের (দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পাওয়ায়) যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীদের কাজের সমালোচনা করলে দলীয় সাংসদগণ দু'ভাবে বিপদগ্রস্ত হন। প্রথমত এর ফলে দলীয় সভানেত্রী ও সংসদ নেত্রীর আস্থাভাজন থাকতে পারেন এবং অন্যদিকে বেশি বাড়াবাড়ি করলে ৭০-এর (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে তিনি সাংসদই থাকতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত বিরোধী দলগুলোর সংখ্যা এতই নগণ্য যে, তারা সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরিবর্তে সংসদের বাইরে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। কারণ তাদের সংখ্যা এবং বিভিন্ন সময় সরকারে থাকা অবস্থায় তাদের কর্মকাণ্ড এতই বিতর্কিত যে, প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীদের সমালোচনা করার জন্য যথেষ্ট সামর্থ্য তাদের থাকে না। তাছাড়া, স্পিকার সরকার দলের হওয়ায় (তার ভাগ্যও রাষ্ট্রপতির মতো প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল) তিনিও সংসদে এমন পরিবেশ তৈরি করার ঝুঁকি নেন না যার ফলে তার চাকরিটাই হারাতে হয়। এজন্য যে দলই ক্ষমতায় আসুক স্পিকারকে অন্তত দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার সুযোগ দিতে হবে। যার ফলে একটি সংসদে এক ধরনের ভারসাম্য অবস্থা তৈরি হবে। অনুচ্ছেদ ৫৭ কারণে রাষ্ট্রপতির মতো প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ লাভ বা আসীন থাকা রাষ্ট্রের অন্য কারোরই আস্থার উপর নির্ভর নয়। কারণ সাংসদরা ৭০(১) অনুচ্ছেদের কারণে তার বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না এবং রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার এমন কোনো সাংবিধানিক বা ডিফেক্টো অধিকার ভোগ করেন না যার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী তার পদ থেকে অপসারিত হতে পারেন। তাছাড়া, ৫৮(২) অনুসারে মন্ত্রীদের পদে থাকাটাও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার উপরই নির্ভর করে। সুতরাং অন্তত পাঁচ বছরের জন্য যে কোনো দলের প্রধানমন্ত্রীই বাংলাদেশে একনায়ক। সংসদের বৈঠক আহ্বান, সমাপ্তি এবং সংসদকে ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তাও সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ পরামর্শের উপর নির্ভরশীল। সংসদে আইন প্রণয়নে বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীরই সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এখানে ৪০(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আর অর্থ বিলকে তো অনুচ্ছেদ ৮১(৩) আদালতেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখেছে। ৯৩(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ তৈরি করতে পারলেও ৯৩(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে সেই অধ্যাদেশ সংসদে অনুমোদিত হতে হবে এবং এভাবে ঐ প্রধানমন্ত্রীই আসল। যদিও এই ক্ষমতাটা সংসদের হাতে থাকা উচিত, প্রধানমন্ত্রীর হাতে নয়। কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতা অনুশীলন করেন ঐ প্রধানমন্ত্রীই। আসলে সকল সমস্যা ঐ এক দলের সংসদ হওয়ায়। গত দু'টি নির্বাচনে জনগণ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন বিএনপি বা আওয়ামী লীগকে দিয়েছে, যার ফলে প্রধানমন্ত্রীই বাস্তবে আরো ক্ষমতাধর হয়েছেন। কারণ ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সরকার দু'টির প্রধানমন্ত্রীরা ২০০১ ও ২০০৮-এর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে কম কর্তৃত্ববান ছিলেন। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীই সাংবিধানিকভাবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বাস্তবে সকল ক্ষমতার মালিক। সংসদ তাকে বর্তমান কাঠামোতে জবাবদিহিতার অধীন করতে পারবে না। বিচার বিভাগও পারবে না। কারণ প্রধান বিচারপতি ও এটর্নি জেনারেলের ভাগ্য বাস্তবে তার আস্থার উপরই নির্ভর করে। রাষ্ট্রপতিও তাকে কিছুই করতে পারবেন না। কারণ তিনি ঐতিহ্যগতভাবে, সাংবিধানিকভাবে বা দলীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতাই ভোগ করেন না। তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন রাষ্ট্রপতি, ব্রিটিশ রানি বা প্রধানমন্ত্রী বা ফরাসী প্রেসিডেন্ট বা জার্মান চ্যান্সেলর সবার চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী। এই ক্ষমতা এমন যেন তিনি অন্তত পাঁচ বছরের জন্য একনায়ক। বিরোধী দলগুলোর কোনো আন্দোলনও তাকে অপসারণ করতে পারবে না। কারণ তার আছে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি ক্ষমতা এবং দলীয় একচ্ছত্র আধিপত্য দেশব্যাপী। তিনি সামরিক বাহিনীর সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী। কারণ বাস্তবে প্রধান সেনাপতির ভাগ্যও তার ইচ্ছার অধীন। অনুচ্ছেদ ৬৩ অনুসারে যুদ্ধে যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারটিও ঐ প্রধানমন্ত্রীর উপর নির্ভরশীল (কারণ তিনি সংসদ নেতা আর সংসদের সম্মতি ছাড়া যুদ্ধেও যাওয়া যায় না)। তাই তাকে নিয়োগদান এবং তার দল থেকে আলাদা করা বা নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে (দলীয় প্রধান বা সরকার প্রধান হিসেবে দুই মেয়াদের জন্য) সীমাবদ্ধ করা ছাড়া বাংলাদেশে হাজার বছর সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করলেও রাষ্ট্রের দুর্দশায় কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নাই। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে কোনো লাভ হবে না। কারণ বর্তমানে তার যে ক্ষমতা রয়েছে তাই তিনি প্রয়োগ করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ নেত্রী, শাসন বিভাগের প্রধান এবং সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি যে সকল ক্ষমতা ভোগ করেন তার ডিফেক্টো নিয়ন্ত্রক। তাই প্রধানমন্ত্রীই সর্বেস্বর। সর্বোপরি, ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলের মতো বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল কোনোভাবেই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাছাড়া, বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত থাকা এবং ছায়া সরকার গঠনে ব্যর্থতা প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভাকে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসতে পারেনি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এমন মানসিক অবস্থা তৈরি করে যে, নির্বাচনে কোনো দল সরকার গঠনের মতো বিজয় অর্জন করলে এ বিজয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা যতটা না দলীয় কার্যক্রমের ফল মনে করেন তার চেয়ে বেশি এটা জিয়াউর রহমান বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি মানুষের আস্থার প্রতিফলন হিসেবে মনে করেন। এক্ষেত্রে নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণের বিশ্বাসও অনেকটা একইরকম। এই অবস্থায় সরকার গঠনের পর ব্যক্তি শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার ক্ষমতা অন্য সকলের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে বহুগুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে যে প্রক্রিয়ায় দলগুলো সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান করে, এমনকি যখন মিডিয়ায় বা গবেষণায় মনোনয়ন বাণিজ্য পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয় তখন মনে রাখতে হবে যে, প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসী, ব্যবসায়ী, অরাজনৈতিক ব্যক্তি, দুর্নীতিবাজ দলের মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হয়ে আসেন ঠিক সেই প্রক্রিয়ায় তারা সংসদ সদস্য হওয়ার পরেও ৭০ অনুচ্ছেদ না থাকলে নির্বাচিত হওয়ার পর অন্য গোষ্ঠীর বা বিরোধী দলের কেনা-বেচার পাত্র হতে পারবেন। তখন বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক নৈরাজ্যের সাথে সাংবিধানিক নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং প্রতি মাসে মন্ত্রিসভা গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া তখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনুঘটকগুলোর ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারে। এটা আরও বেশি ভয়ঙ্কর। তবে সংসদে রাজনীতি কার্যকর করতে হলে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল আবশ্যক। কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রে তার আগে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তথা দলীয় কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা এবং সংসদে বিরোধী দলের কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে মিডিয়া ও সুশীল সমাজ কিছু সাংবিধানিক সংশোধনী আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দিতে পারে। এই সংশোধনী হবে প্রধানত দলীয় কাউন্সিলের ব্যাপারে এবং বিরোধী দলকে সংসদে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়ায় বাধ্য করা। অন্যদিকে ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলে শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে যে ঐক্য সেটা বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করলেও এটা ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলে আবশ্যক। এছাড়া শাসন বিভাগ যে সকল নীতি গ্রহণ করবে সেগুলো সংসদে পাস করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রী একজন সরকারি সচিবে পরিণত হবেন। একইভাবে ব্রিটেনে রানি কোনো সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দলের বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে পদে নিয়োগ লাভ না করায় এবং বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি দলের আস্থাভাজন ও ত্যাগী নেতা হিসেবে নিয়োগ লাভ করায় ব্রিটেনে বিচারপতিদের নিয়োগে শাসন বিভাগ বা প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব বিস্তার পরিচ্ছন্ন এবং বিচারকগণ সরকার গঠনকারী দলের আস্থাভাজন হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন না। অন্যদিকে বাংলাদেশে কোনো না কোনোভাবে বিচারকগণ নিয়োগ লাভ করেন প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের সময় লক্ষ্য ছিল শুধু এরশাদের পতন, এক্ষেত্রে কারো কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিল না। ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৫৪'র নির্বাচন, ৬৬'র ছয় দফা, ৬৯'র গণঅভ্যুত্থান ও ৭০'র নির্বাচনের সময় আমরা যেভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছি ৯০'র গণঅভ্যুত্থানের সময় সে ধরনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও পরিকল্পনা ছিল না। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্রকে রুদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার জন্য যে সাংবিধানিক ম্যাকানিজম দরকার সেটা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, স্বাধীনতা লাভের ত্রিশ বছর পর বা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পনের বছর পর আমরা স্বাধীন দুর্নীতিদমন কমিশন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আইনি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পেরেছি। তাই পরিশেষে বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্র দূর করতে এখনই ৭০'র অনুচ্ছেদ বাতিল করার সময় নয়, বরং সাংবিধানিকভাবে দলীয় কাউন্সিলকে কার্যকর ও জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা এবং বিরোধী দলকে সাংবিধানিকভাবে সংসদ বর্জন না করতে বাধ্য করার মাধ্যমেই এটা নিশ্চিত হতে পারে। এভাবে কোনো দলের সরকার গঠনের মতো বিজয় অর্জন আর ঐ দলের আদর্শিক নেতার প্রতি জনগণের সমর্থন হিসেবে দেখার মানসিকতাও দূর হবে। আর এভাবেই বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্র দূর হতে পারে। লেখক: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
Wednesday, June 5, 2013
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment