বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা সংবিধানে 'অস্থায়ী' করল সরকার
২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম এবং ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধান হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের নব সংযোজিত ১৫০(২) নং অনুচ্ছেদে বাঙালি জাতির ভাগ্য রচনাকারী জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি কি তাহলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ইতিহাসের কোনো অস্থায়ী বিষয় ছিল? বাঙালি জাতির হাজার বছরের এই মহানায়ক ও স্বাধীনতার ঐতিহাসিক দলিলগুলো কি নিছক ক্রান্তিকালীন কোনো বিষয় ছিল? আর বঙ্গবন্ধু কি তাহলে বাঙালির ইতিহাসের নিছক কোনো অস্থায়ী বিষয়? বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি এই দেশের স্বাধীনতাকে তিরিশ লাখ শহীদের আত্দত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করেছিল সেই বঙ্গবন্ধুর নিজের দলই কিনা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুকে আর তার ঐতিহাসিক ভাষণকে অস্থায়ী ঘোষণা করে দিল! পৃথিবীর মাত্র দুটি দেশ, আমেরিকা এবং বাংলাদেশের সংবিধানের জন্ম হয়েছে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের গর্বের ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দলিলটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানেরও গৌরব। অথচ বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত দলের সরকার সংবিধানে ১৫০(২) অনুচ্ছেদে এই ঐতিহাসিক দলিলটিকে অস্থায়ী ঘোষণা করল। আসলে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের বিষয়টিই বেশি করে আলোচনায় এসেছে। তত্ত্বাবধায়কের রাজনৈতিক বিতর্কে ঢাকা পড়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংশোধনী। যেমন এই সংশোধনীতে বলপ্রয়োগ করে সংবিধান সংশোধন, বাতিল বা স্থগিতকরণকে এবং সংবিধানের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি, সহযোগিতা, উসকানি ও সর্মথনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সংবিধানের তিন ভাগের এক ভাগ অংশকে মৌলিক কাঠামো আখ্যায়িত করে চিরতরে এগুলোর সংশোধন অবৈধ করা হয়েছে।
অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র বা সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলী সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদ বলে কোনোভাবেই আর কখনো সংযোজন, পরিবর্ধন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন করা যাবে না। অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে এবং জাতির গৌরবময় এই ইতিহাসকে অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধান রহিত করে কোনো প্রকার সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। তাহলে তো এই সরকারও সংবিধান অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর এই অস্থায়ী রূপকে আর কখনো স্থায়ী করতে পারবে না। বরং পরবর্তীতে যে সরকারই আসুক না কেন তাদের পক্ষেও অসম্ভব হবে এই ভুলকে সংশোধন করা। কারণ আমরা তো সাংবিধানিকভাবে এটাকে সংশোধনের অযোগ্য করে দিয়েছি। মূলত পঞ্চদশ সংশোধনী করার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল সংসদে, সম্ভবত তাদের মাথায় এটি ছিল, যেভাবেই হোক না কেন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধটিটা বাতিল করতে হবে। যার ফলে এই ধরনের মারাত্দক একটি ভুল করা হলো। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট সংসদীয় এই বিশেষ কমিটি অসম্ভব দ্রুতগতিতে একতরফাভাবে বিরোধী দল বিএনপির কোনো সংসদ ছাড়াই সংবিধানের এই সংশোধনগুলো এনেছে। এই কমিটির কোনো টার্মস অব রেফারেন্স পর্যন্ত করা হয়নি। এই কমিটি ২৭টি বৈঠক করা ছাড়াও তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১১ জন আইনজ্ঞ, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী, ১৮টি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মতামত নিলেও বিল পাসের সময় এই মতামতগুলোকে কোনো তোয়াক্কা করেনি। সংবিধানের এত বড় সংশোধনী পাস করা হয় বাজেট অধিবেশনে। এর জন্য বিশেষ কোনো অধিবেশন পর্যন্ত ডাকার প্রয়োজন মনে করা হয়নি। সংসদে রাবার স্ট্যাম্পের মতো হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে বলে ছাপ দিয়ে পাস করা হয় এই বিলটি। এরকম একটি গোঁজামিলের সংশোধনীর ব্যাপারে মানুষ যাতে প্রশ্ন না করতে পারে সে জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। সংবিধানের কোনো বিধান কোনো সংসদ কোনো দিনই আর সংশোধন পরিবর্তন করতে পারবে না, এমন বিধান পৃথিবীর কোথাও নেই। এটা গণতান্ত্রিক আদর্শেরও পুরোপুরি বিপরীত ব্যবস্থা এবং এটা করে সংবিধান নিয়ে মানুষের সুস্থ চিন্তা, মতপ্রকাশ, বাকস্বাধীনতা ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার পথকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পরিণত হলো অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধানে।
লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র বা সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলী সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদ বলে কোনোভাবেই আর কখনো সংযোজন, পরিবর্ধন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন করা যাবে না। অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে এবং জাতির গৌরবময় এই ইতিহাসকে অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধান রহিত করে কোনো প্রকার সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। তাহলে তো এই সরকারও সংবিধান অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর এই অস্থায়ী রূপকে আর কখনো স্থায়ী করতে পারবে না। বরং পরবর্তীতে যে সরকারই আসুক না কেন তাদের পক্ষেও অসম্ভব হবে এই ভুলকে সংশোধন করা। কারণ আমরা তো সাংবিধানিকভাবে এটাকে সংশোধনের অযোগ্য করে দিয়েছি। মূলত পঞ্চদশ সংশোধনী করার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল সংসদে, সম্ভবত তাদের মাথায় এটি ছিল, যেভাবেই হোক না কেন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধটিটা বাতিল করতে হবে। যার ফলে এই ধরনের মারাত্দক একটি ভুল করা হলো। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট সংসদীয় এই বিশেষ কমিটি অসম্ভব দ্রুতগতিতে একতরফাভাবে বিরোধী দল বিএনপির কোনো সংসদ ছাড়াই সংবিধানের এই সংশোধনগুলো এনেছে। এই কমিটির কোনো টার্মস অব রেফারেন্স পর্যন্ত করা হয়নি। এই কমিটি ২৭টি বৈঠক করা ছাড়াও তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১১ জন আইনজ্ঞ, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী, ১৮টি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মতামত নিলেও বিল পাসের সময় এই মতামতগুলোকে কোনো তোয়াক্কা করেনি। সংবিধানের এত বড় সংশোধনী পাস করা হয় বাজেট অধিবেশনে। এর জন্য বিশেষ কোনো অধিবেশন পর্যন্ত ডাকার প্রয়োজন মনে করা হয়নি। সংসদে রাবার স্ট্যাম্পের মতো হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে বলে ছাপ দিয়ে পাস করা হয় এই বিলটি। এরকম একটি গোঁজামিলের সংশোধনীর ব্যাপারে মানুষ যাতে প্রশ্ন না করতে পারে সে জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। সংবিধানের কোনো বিধান কোনো সংসদ কোনো দিনই আর সংশোধন পরিবর্তন করতে পারবে না, এমন বিধান পৃথিবীর কোথাও নেই। এটা গণতান্ত্রিক আদর্শেরও পুরোপুরি বিপরীত ব্যবস্থা এবং এটা করে সংবিধান নিয়ে মানুষের সুস্থ চিন্তা, মতপ্রকাশ, বাকস্বাধীনতা ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার পথকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পরিণত হলো অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধানে।
লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments:
Post a Comment